বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ৫ মিলিয়ন এর চেয়েও বেশি ইলেকট্রিক কার রয়েছে। যেখানে ২০১০ সালে ইলেকট্রিক কারের পরিমাণ ছিলো কয়েক হাজার, সেখানে বিশ্বজুড়ে ২০১৯ সালেই বিক্রি হয়েছিল ২.২ মিলিয়ন এর মতো। বিগত দিনগুলোতে Tesla এর গ্রোথ হারই ইঙ্গিত দেয় যে সামনের দিনগুলোতে ইলেকট্রিক কারের মার্কেট কতবড় হতে যাচ্ছে! ইলেকট্রিক কারের মাধ্যমে চায়না, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশ ট্রান্সপোর্টেশনে বড় পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশেও ইলেকট্রিক কার নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। ইলেকট্রিক কারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ততটা এগিয়ে না থাকলেও বেশ কিছু লোকাল কোম্পানি এই সেক্টরে ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছে। আজকের পোস্টে আলোচনা করবো ইলেকট্রিক কারের পথে বাংলাদেশের যাত্রা ও অগ্রগতি নিয়ে।
ইলেকট্রিক কার কি?
ইলেকট্রিক কার বলতে মূলত সেসব গাড়িকে বোঝায়, যেগুলোকে পরিচালনা করার জন্য এক বা একাধিক মোটর ব্যাবহার করা হয়। সাধারণ ফুয়েল ব্যাবহার না করে পরিবেশবান্ধব লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি ব্যাবহৃত হয়। তবে সম্প্রতি ইলেকট্রিক কারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। পরিবেশ দূষণ থেকে বাঁচতে এই পরিবেশবান্ধব গাড়ি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে ট্রান্সপোর্টশনের পরিবর্তন এনে পরিবেশ, পরিবহন ও পরিবেশ দূষণ নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এই ইলেকট্রিক কারগুলো। বিশ্বে সকল প্রকার ইঞ্জিন থেকে প্রায় ২৪% কার্বনডাইঅক্সাইড নির্গমন হচ্ছে।অপরদিকে যদিও ইলেকট্রিক কার কার্বনডাইঅক্সাইড নির্গমন করে না তবে ইলেকট্রিসিটি কোথা থেকে উৎপন্ন হচ্ছে সেটিও দেখার বিষয়।
গ্লোবাল ইলেকট্রিক কার মার্কেট
বিগতদশকে ইলেকট্রিক কার মার্কেটের প্রবৃদ্ধি ছিলো লক্ষ্যনীয়। প্রতিটি দেশই তাদের নিজ নিজ দেশের ট্রান্সপোর্টশনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যাবহারে সরকারি ও রাজনৈতিক ভাবে অর্থ বিনিয়োগ করেছে। যার ফলে অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতে ইলেকট্রিক কারের মার্কেটশেয়ারও বাড়ছে প্রতিনিয়ত। ২০১৯ সালে গ্লোবাল মার্কেটে ইলেকট্রিক কারের শেয়ার ছিলো ২.৬%। ২.২ মিলিয়ন ইলেকট্রিক কার নিয়ে সবার শীর্ষে আছে চায়না। সকল এক্টিভ ইলেকট্রিক কারই আছে চায়নাতে। চায়নার পরই আছে ইউরোপ ও ইউএসএ। যেখানে ১.২ মিলিয়ন ও ১.১ মিলিয়ন কার আছে। চায়নাতে ইলেকট্রিক কারের পরিমান বেশি হলেও দেশের মোট গাড়ির ৪% ইলেকট্রিক। সেইদিক থেকে এগিয়ে আছে ইউরোপ। কেননা নরওয়ে তে ব্যাবহৃত সকল গাড়ির ৪৯%ই ইলেকট্রিক। নরওয়ের পরেই আছে আইসলেন্ড ও সুইডেন যেখানে ইলেকট্রিক কারের পরিমাণ যথাক্রমে ১৯% ও ৮%। ২০২৫ সালের মধ্যে অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতে একতৃতীয়াংশ জায়গা করে নিবে ইলেকট্রিক কার এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০% উপরে উঠবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। ২০১৯ সালে ইলেকট্রিক কার মার্কেটের ভ্যালু ছিলো $১৬২, যা ২০২৭ সালের মধ্যে দাঁড়াবে $৮০০ এর মতো।
এশিয়া প্যাসিফিক মার্কেট
এশিয়াতেও ইলেকট্রিক কারের উপর প্রভাব বিস্তার করে আছে চায়না। চায়নার পরেই আছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত। প্রধান ইলেকট্রিক কার ম্যানুফ্যাকচার কোম্পানি হচ্ছে BYD Company, Tesla Company, Nisaan Company, Diamler Company ইত্যাদি। চায়না ও ভারত পরিকল্পনা করেছে তাদের সাধারণ গাড়িগুলোকে ইলেকট্রিক কারের সাথে রিপ্লেস করার। তবে এশিয়া প্যাসিফিকে কম সংখ্যাক গাড়ি অনুপ্রবশের কারণে মানুষের মধ্যে প্রথম গাড়ি হিসেবে ইলেকট্রিক গাড়ি বেছে নেওয়ার প্রবণতা কম থাকবে। যার ফলে ইউরোপ ও ইউএসএ এর তুলনায় এশিয়ার প্যাসিফিকে ইলেকট্রিক গাড়ির পরিমাণ বেশি হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
ইলেকট্রিক কারের বাংলাদেশে বিস্ততি
দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশের ইন্ডাস্ট্রিগুলোর উৎপাদনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে দিন দিন উন্নত সেবার চাহিদাও বাড়ছে। বাংলাদেশের রাস্তাগুলোতে বাসের সংখ্যা বেশি হলেও তা বৃদ্ধির হার অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে।
তবে রাইড শেয়ারিং অ্যাপগুলোর প্রসারে প্রাইভেট কারে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের সেবা দেওয়া বেশ ভালোই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে ধারণা করাই যায় আগামীতে আমাদের দেশে কমফোর্টেবল ট্রান্সপোর্টের চাহিদা বাড়বে, যা আমাদের বাধ্য করবে ইলেকট্রিক কারের দিকে অগ্রসর হতে। বাংলাদেশে ইলেকট্রিক কার বলতে আমরা সাধারণত ইজি বাইক, আটো-রিক্সা বুঝে থাকি। মূলত সিএনজি কে রিপ্লেস করার লক্ষ্যেই ইজিবাইক চালু করা হয়। এতে ৪-৫টি Recharge Lead-Acid ব্যাটারি রয়েছে। যার সাহায্যে পাওয়ার জেনারেট করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ছোট বড় মিলে বিভিন্ন ভার্সনের ইজি বাইক দেখা যায়। সাধারণত ৬-৮জন যাত্রী বহনে সক্ষম এই গাড়িগুলো। গাড়িগুলোকে চার্জ দেওয়ার প্রধান উৎস হচ্ছে Main Grid। ২০১৮ সালেও দেশে প্রায় ১৭৫০০ কোটি টাকার ইজি বাইক মার্কেট ছিলো। তাছাড়াও আমাদের দেশে ইলেকট্রিক রিক্সারও প্রচলন হয়েছে। ২০১০-১১ সালের দিকে আটো রিক্সার প্রচলন শুরু হয়। অটোরিকশার আকার সাধারণ রিকশার মতো হলেও আকারে কিছুটা বড় হয়ে থাকে।
লোকাল ম্যানুফ্যাকচারার
বেশ কিছু লোকাল ম্যানুফ্যাকচারার ইজি বাইকের মতো ইলেকট্রিক গাড়ি ও এদের পার্টস নিয়ে কাজ করছে। এদের মধ্যে Apollo Solar and Power Technologies, Bd Power, Rohimafrozz Globatt LTD, AB Power ইত্যাদি। তবে বেশকিছু কোম্পানি আছে যারা প্যাসেন্জারিটি নিয়ে কাজ করবে। Nitol motors ইতিমধ্যে একটি লোকাল এসিম্বলেড কার নিয়ে আসবে খুব শীঘ্রই। গাড়িটির সাইজ সাধারণ কারের মতোই হবে। গাড়িটির নাম দেওয়া হয়েছে Suvare। এবং এর দাম দেওয়া হয়েছে ১২ লাখ টাকা। লোকাল অটো মোবাইল কোম্পানি বাংলাদেশ আটো ইন্ডাস্ট্রিতে ২০০ মিলিয়ন টাকা বিনিয়োগে ইলেকট্রিক কার ম্যানুফ্যাকচার শুরু করবে। মোট বিনিয়োগের ৮০% আসবে লোকাল বিনিয়োগকারীর থেকে এবং ২০% আসবে বিদেশি বিনিয়োগকারীর থেকে। এ লক্ষ্যে কোম্পানিটি চট্টগ্রামে ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করছে। ব্যাটারি, মোটর, কনট্রোলার, বডিসহ গাড়ির ৬০% তৈরি হবে কোম্পানিটিতে। ইলেকট্রিক কার গুলোতে ব্যাটারি ব্যাবহার করা হবে 50KW। ব্যাটারি গুলোকে ফুল চার্জ দিতে খরচ হবে ৪০০ টাকা। মাত্র ২০ মিনিটের চার্জে ৪০০ কিমি চলতে সক্ষম এই গাড়িগুলো। এতে করে ৯০% জ্বালানি খরচ কমে যাবে এবং প্রতি কিমি তে খরচ হবে ২ টাকারও কম। যেখানে পেট্রোল ইঞ্জিন যানবাহনের প্রতি কিমি তে খরচ হয়ে থাকে ৪-৬ টাকা।
ইলেকট্রিক কারের প্রতিবন্ধকতা
ইলেকট্রিক কার নিয়ে দেশে সম্ভাবনাময় সুযোগ থাকলেও বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হবে আমাদের। তবে সঠিক সময়ে পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে এই সব সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। ২০১১ সালে খুব স্বল্প সময়ে একাধিক দুর্ঘটনা ঘটার কারণে বাংলাদেশের মহাসড়ক হতে ইলেকট্রিক গাড়িগুলোকে সড়িয়ে নেওয়া হয়। তাই অন্যান্য গাড়িগুলোর সাথে তুলনা করলে আমাদের দেশে ইলেকট্রনিক গাড়ির চাহিদা অনেকটাই কম। গড়ে প্রতিবছর দেশে ইলেকট্রিক গাড়ির চাহিদা আছে ৩০,০০০ ইউনিট। এটি ইঙ্গিত দেয় যে ম্যাক্স প্রোডাকশনের জন্য স্থানীয় মার্কেটের চাহিদা পর্যাপ্ত হবে না। প্রোডাকশনের চাহিদা বাড়াতে হলে আমাদের এক্সপোর্টের দিকে নজর দিতে হবে। সেই সাথে দেশে ইলেকট্রিক গাড়ির দক্ষতা বাড়াতে হবে এবং সুরক্ষা ব্যাবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ইলেকট্রিক গাড়িগুলো BRTA কর্তৃক রেজিষ্ট্রেশন করার জন্য বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়। কেননা BRTA গাড়ির রেজিষ্ট্রেশন করে CC(Cubic Capacity) উপর ভিত্তি করে। কিন্তু ইলেকট্রিক গাড়িগুলো CC তে পরিমাপ করা যায় না। এক্ষেত্রে রেজিষ্ট্রেশনে বেশ কিছু ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়।
আমাদের দেশে এখনও যেসব ইজিবাইক বা অটোরিকশা চলছে সেগুলোর কোনটাই রেজিস্ট্রেশন করা না।
বাংলাদেশে ইলেকট্রিক কারের ভবিষ্যত
২০১৩ সালে দেশে মোট ইলেকট্রিক গাড়ির সংখ্যা ছিলো ৩৯৭০০০। ২০১৯ এ তা বেড়ে ১৫০০০০০ হয়েছে। আগামী দিনগুলোতেও গাড়ির চাহিদা বাড়বে বলে ধারনা করা হচ্ছে। সেই সাথে ইলেকট্রিক
প্যাসেন্জার কারের বিস্তারের সুযোগও রয়েছে। রিসাইকিলিং এর দিক থেকে ROHIMAFROOZ ও Confidence Battery Limited ব্যাটারি তৈরির পাশাপাশি রিসাইকিলিং প্লান্টও স্থাপন করেছে। বিশেষ করে Rohimafrooz এর কথা বলতে হয়। তারা তাদের রিসাইকিলিং প্লান্টে প্রচুর ইনভেস্ট করতেছে। যেখানে তারা পুরান ব্যাটারি থেকে শিশা কলেক্ট করে তা আবার ব্যাবহার উপযোগী করে তুলছে। তাছাড়া রিসাইকেল নিয়ে তারা বেশ কিছু সচেতনামূলক কার্যক্রমও পরিচালনা করতেছে। এবং ব্যাটারি ইউজার দের পুরাতন ব্যাটারি রিপ্লেসে নতুন ব্যাটারি ব্যাবহারে উৎসাহিত করছে। নিঃসন্দেহে Rohimafrooz এর এসব কার্যক্রম অন্যান্য কোম্পানির জন্য উদাহরণস্বরূপ। বর্তমানে দেশে অনেকেই প্লাগিন হাইব্রিড গাড়ি কিনছে। এতে করে বোঝা যায় আমাদের দেশে ইলেকট্রিক কারের চাহিদা বাড়বে। তবে দেশে ইলেকট্রিক কারের পরিমাণ বৃদ্ধি করার জন্য দরকার সরকারের যথেষ্ট সহোযোগিতা ও সহায়তা। এগুলোর মধ্যে ব্যাটারি ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়নের প্রচার, বিস্তার ও অবকাঠামোর জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর সহজলভ্যতা। পাশাপাশি চায়না, আস্ট্রেলিয়ার মতো লিথিয়াম আয়নের ব্যাটারি প্রস্তুতকারক দেশগুলোর সাথে দীর্ঘমেয়াদের চুক্তি করা প্রয়োজন। তাছাড়াও সরকারের উচিৎ ইলেকট্রিক কারের জন্য নেওয়া চায়নাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গুলো অনুসরণ করা। সর্বোপরি ইলেকট্রিক কারগুলোর আমদানিতে ট্যাক্স কমিয়ে আনা যাতে করে অন্যান্য গাড়ি কেনার পাশাপাশি ইলেকট্রিক গাড়ি কিনতে আগ্রহ হয়।
তবে আপনাদের কি মনে হয়? বাংলাদেশ কি পারবে বিশ্বের অন্যান্য দেশ গুলোর মতো ইলেকট্রিক গাড়ির বিস্তার ঘটাতে? তা করতে হলে আর কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ বলে মনে হয়? অবশ্যই আমাদের কমেন্ট করে জানাবেন।