“বাংলাদেশের ষড়ঝতু” প্রবন্ধ রচনা [১৫টি পয়েন্ট]

“বাংলাদেশের ষড়ঝতু” প্রবন্ধ রচনা

ভূমিকা: বাংলাদেশ অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ। ঋতুবৈচিত্রের কারণেই এ অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ফুটে ওঠে বাংলার পথে-প্রান্তরে। ঋতুতে ঋতুতে বাংলার চারপাশে রূপের মেলা বসে। রূপের ঐশ্বর্যে এ মেলা উদ্ভাসিত হয় রং ও সুরের খেলায়। অনুপম বৈচিত্র্যময় ঋতুরঙ্গের এমন উজ্জ্বল প্রকাশ বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। তাই তাে কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলাদেশকে ‘রূপসী বাংলা বলেছেন। প্রতিটি ঋতু এখানে প্রকৃতিকে সাজায় তার অনুপম রূপসজ্জায়। তারপর সেই রূপ বিদায় নেয়, আসে আরেক ঋতু। ঋতুর এই পালাবদল চলতে থাকে বছর জুড়ে।

ঋতু: আবহাওয়ার ওপর ভিত্তি করে ঋতু নির্ধারিত হয়। তাই একই সময়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকমের ঋতুর দেখা পাওয়া যায়। এ কারণে ভৌগােলিক সীমারেখার ভিন্নতায় কোথাও শীত, কোথাও গরম পরিলক্ষিত হয়।

ষড়ঋতুর পরিচয়: বাংলাদেশকে ষড়ঋতুর দেশ বলা হয়। এখানে বারাে মাসে ছয় ঋতু, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। প্রতি দুই মাস পর পর ঋতু বদল হয়। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাস মিলে গ্রীষ্মকাল, আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল, ভাদ্র-আশ্বিন শরকাল, কার্তিক-অগ্রহায়ণ হেমন্তকাল, পৌষ-মাঘ শীতকাল এবং ফানুন-চৈত্র মাস’মিলে বসন্তকাল। প্রতিটি ঋতু তার অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসে এবং অনাবিল সৌন্দর্য উপহার দিয়ে বিদায় নেয়। বাংলাদেশে ছয়টি ঋতু থাকলেও আবহাওয়ার উষ্ণতার তারতম্যের ওপর ভিত্তি করে তিনটি ঋতু পরিলক্ষিত হয় শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা।

ষড়ঋতু: বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর ঋতুবৈচিত্র্যের মধ্যে প্রত্যক্ষ করা যায়। ঋতুতে ঋতুতে আবহাওয়া ও তাপমাত্রার পরিবর্তন হয়। সেইসাথে প্রকৃতির দান বিভিন্ন ফুল, ফল, শস্য এবং মানুষের জীবনযাপনে পরিবর্তন সাধিত হয় ঋতুবিশেষে। বাংলাদেশের প্রকৃতির ঋতুরঙ্গশালার প্রথম ঋতু গ্রীষ্ম। ধু-ধু চোখে প্রখর অগ্নিদাহ নিয়ে আবির্ভাব ঘটে এ রুদ্র তাপসের । সমগ্র জীবজগৎ ও উদ্ভিদ জগতে নেমে আসে প্রাণহীন, রসহীন বিবর্ণতার পাণ্ডুর ছায়া। এ সময় প্রকৃতিকে তােলপাড় করে দিয়ে যায় কালবৈশাখীর ভয়াল ছােবল।

মাঝে মাঝে দুপুরবেলা তপ্ত গরমে দুঃসহ হয়ে ওঠে মানুষের জীবনধারা চৌচির হয়ে যায় মাঠ-ঘাট-প্রান্তর। গ্রীস্ম ফলের ঋতু, এসময় প্রকৃতি বিভিন্ন রকমের ফলের ডালা সাজিয়ে বসে। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু গ্রীষ্মের উল্লেখযােগ্য ফল।

বাংলাদেশে বর্ষা আসে বিদ্যুৎ তরঙ্গের কলকানি ও গুরুগম্ভীর বহুনির অতি হরষের মধ্য দিয়ে রাজ-সমারােহে। এসময় সমস্ত আকাশের বুকে স্তরে স্তরে জমে থাকে নতুন মেঘের ভূপ। অপূর্ব সমারােহে আকাশ-বাতাস ব্যাপ্ত করে আসে শ্যামল, সুন্দর, নয়নাভিরাম বর্ষা। এসময় সুদূর দিগন্ত থেকে দুরন্ত বাতাস বইতে থাকে। দগ্ধ পৃথিবীর ধূসর বুকে নেমে আসে স্নিদ্ধশীতল বণধারা। বহুদিন পর শুষ্ক মাঠ-প্রান্তর, জলাশয়, নদী-নালা, খাল-বিল ও অরণ্যের প্রাণে জেগে ওঠে প্রবল প্রাণের উচ্ছ্বাস। প্রকৃতি থেকে গ্রীষ্মের ধূসর ক্লান্তি মুছে যায়, উদ্ভাসিত হয় সজল বর্ষার রূপশ্রী।

পাখির গান, ফুলের সৌরভে ভরে ওঠে চারদিক। মাটির কঠিন শাসন ভেদ করে নবীন শস্যের নবজীবনের জয়যাত্রা শুরু হয়। কদম, কেয়া, জুই, গন্ধরাজ ও হাসনাহেনার বিচিত্র বর্ণ ও গন্ধে প্রকৃতির দ্বার খুলে যায়। সৌন্দর্যের ডালা সাজিয়ে শরৎ আসে রূপসী বাংলায়। এসময় ক্লান্ত হালয় সাদা মেঘ অলস ভেসে বেড়ায় নিরুদ্দেশের পথে। বর্ষণ-ধৌত, মেঘমুক্ত আকাশের সুনীল ৰূপ, আলাে-ছায়ার লুকোচুরি চলে নিমেষে। আর শিউলি ফুলের মন-উদাস করা গন্ধ, নদী তীরে কাশফুলের অপূর্ব সমারােহ, রূপালি জ্যোৎস্না পুলকিত রাত্রি যেন শরতের আনন্দময় আবির্ভাব। সঙ্গে সঙ্গে বাংলার চারদিকে সৌন্দর্যের দরজা খুলে যায়। এসময় আকাশ নিয়ে হয়। সােনার রং ধরে শরতের রােদ্দুর। আসে শারদীয় উৎসব, হিন্দু সম্প্রদায় দুর্গাপূজার আনন্দে মেতে ওঠে। হেমন্ত শরতের বিলম্বিত রূপ। কিন্তু হেমন্তের নেই শরতের মতাে বর্ণবাহার, আছে সুদূর ব্যাপ্ত বৈরাগ্যের গভীর বিষন্নতা। যেন উদাসীন, প্রৌঢ় এবং বিষণ। ধূসর কুয়াশার আবরণে মুখ ঢেকে ফসল ফলাবার নিঃসঙ্গ সাধনায় নিমগ্ন থাকে হেমন্ত। এসময় যেতে সােনাভরা ধান উঠতে থাকে। চারদিকে কৃষকের অন্তহীন কর্মব্যস্ততা। হেমন্তে ফুলের বাহার নেই, সৌন্দর্যের জৌলুস নেই, রূপ-সজ্জারও নেই প্রাচুর্য; আছে শুধু মমতাময়ী নারীর এক অনির্বচনীয় কল্যাণী রূপশ্রী। রাতের শিশিরে সিক্ত হয় ঘাস, গুল্ম-লতাপাতা। তারপর শিশিরের নিঃসঙ্গ চরণে লাজুক হেমন্ত বিদায় নেয়।

হেমন্তের প্রৌঢ়ত্বের পর আসে জড়তাগ্রস্ত শীতের নির্মম বার্ধক্য। এসময় বৃষ্টি হয় না। মাঠঘাট সীমাহীন শূন্যতা ও ধুলায় ভরা থাকে। গাছের পাতা ঝরে পড়ে শ্রীহীন হয়ে যায়। এসময় তাপমাত্রা কম থাকে বলে মানুষ মােটা ও গরম কাপড় পরিধান করে। রাতে লেপ, কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমায়। কনকনে শীতের তীব্রতা এবং শিশিরভেল কুয়াশা ঘেরা ভােরে মানুষের কাজে মন বসে না। তারপরও ঘরে ঘরে আনন্দ। খেজুরের রস, বিভিন্ন ধরনের পিঠা-পায়েস, মুড়ি-মুড়কির আনন্দে সবাই শীতের রূপ বৈচিত্র্যকে উপভােগ করে। 

শীতের পর আসে ঋতুরাজ বসন্ত। এটিই শেষ ঋতু। গাছে গাছে তখন রিক শাখায় কচি পাতা দেখা যায়। চারপাশ ভরে যায় নানা রঙের ফুলে। দক্ষিণে মৃদুমন্দ বাতাস বইতে থাকে শীতের জরাগ্রস্ত পৃথিবীর বুকে শিহরণ জাগাতে। বাতাসের মর্মর ধ্বনি আর কোকিলের কুহু কুহু ডাক বাংলার প্রকৃতিতে অনুরাগের প্লাবন আনে। শিমুল, কৃষ্ণচূড়া, পলাশের রক্তিম উচ্ছাসে মধুমালতী ও মাধবীলতার রূপের মাধুরীতে চারপাশে লেগে যায় এক আশ্চর্য মাতামাতি। শিমুল-কৃষ্ণচূড়ার রত্তিমতায় চিরযৌবন বসন্তরাজ যেন এক মায়াবী-জাদুকর, রূপশিল্পী। তার উজ্জ্বল বর্ণ ও গন্ধে শূন্যতার অবসান ঘটিয়ে অফুরন্ত প্রাণ-বন্যায় সে মেতে ওঠে। আবার প্রাণ-প্রাচুর্যের অবসান ঘটিয়ে একসময় বিদায় নেয় ঋতুরাজ বসন্ত।

ষড়ঋতুর গুরুত্ব: বাংলাদেশে ষড়ঋতুর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিটি ঋতুতে বাংলার প্রকৃতি পরিবর্তনের সাথে সাথে বিভিন্ন ধরনের শস্য, ফল এবং জলজ প্রাণী তথা মাছের বৈচিত্র দেখা যায়। ঋতুভেদে বিভিন্ন ধরনের শস্য ফলে বাংলাদেশে। গ্রীষ্মকালে একধরনের শস্য আবার শীত বা বর্ষাকালে আরেক ধরনের শস্য উৎপন্ন হয়। কখনাে ধান, কখনাে পাট, কখনাে সরিষা বা সবজি, ফলে। এ কারণেই বাংলাদেশকে কৃষিপ্রধান দেশ বলা হয় । ফলের ক্ষেত্রে ঋতুর প্রভাব সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয়। প্রতিটি ঋতুতে যেন নতুন নতুন ফলের সমাহার ঘটে এই দেশে। বাংলাদেশ নদীপ্রধান দেশও। বর্ষায় নদী-নালা, খাল-বিল ভরে যায় পানিতে। এই বর্ষাকালের ওপর নির্ভর করে মানুষের জীবিকা নির্বাহের উপায় তৈরি হয়। আবার গ্রীষ্ম বা শীতকালেও নদী ও পুকুরে মাছ পাওয়া যায়। তাই বলা যায়, বাংলাদেশের ষড়ঋতু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রসহ বিভিন্নভাবে গুরুত্বপূর্ণ। জীবন-সংস্কৃতিতে ষড়ঋতু বাংলাদেশের ষড়ঋতু এখানকার মানুষের জীবনসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটা উল্লেখযােগ্য অংশ জুড়ে রয়েছে ঋতুর প্রভাব। ঋতুকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে কবিতা, গান, উপন্যাস, নাটকসহ সাহিত্যের বিভিন্ন উপাদান। রবীন্দ্রনাথের ঋতু বিষয়ক নাটক ও গান আমাদের অমূল্য সম্পদ। এছাড়া ভাটিয়ালি ও ভাওয়াইয়া নদীবিধৌত এলকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে। এছাড়া আমাদের বিভিন্ন লােকজ উৎসব ঋতুকে ভিত্তি করেই তৈরি, যা এখন নগর সভ্যতায়ও স্থান পেয়েছে, পেয়েছে সর্বজনীনতা। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য পলাে বৈশাখ, নবান্ন উৎসব, চৈত্র সংক্রান্তি, হালখাতা ইত্যাদি।

উপসংহার: রূপসী বাংলার এরকম বিচিত্র ঋতুচক্র নানা গন্ধ-বর্ণ নিয়ে প্রতিনিয়ত আবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু শহুরে সভ্যতায় বাঙালি আজ আর অন্তর দিয়ে অনুভব করে না এ ঋতুবৈচিত্র্য। আজ আমরা প্রকৃতিকে নির্বাসিত।করে বরণ করে নিচ্ছি নাগরিক সভ্যতার কৃত্রিমতা ও যান্ত্রিকতা। তাই প্রকৃতিও আজ বিরূপ আচরণ করছে। হারিয়ে যাচ্ছে ঋতুর রং, রূপ ও বৈচিত্র্য। উপেক্ষিত প্রকৃতিও বিরূপ আচরণে প্রস্তুত হচ্ছে।   

Leave a Comment