“বর্ষাকাল” রচনা [২০টি পয়েন্ট] PDF

বর্ষাকাল

বা বর্ষায় বাংলাদেশ

বা বাংলার বর্ষা

বা আমার প্রিয় ঋতু

 

ভূমিকা : ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। বিভিন্ন ঋতুর আগমনে এখানে অতুলনীয় প্রাকৃতিক লীলাবৈচিত্র্যের সমারােহ ঘটে। কদম্ব, কেতকী, ঘূথিকা, গন্ধরাজ, হাসনাহেনার গন্ধবাহার বর্ষা প্রকৃতির অনির্বচনীয়।প্ৰকাশ । তাই বসন্তকে ঋতুরাজ বললেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বর্ষাই বাংলার প্রিয় ঋতু।

 

বর্ষার সময় : আষাঢ় ও শ্রাবণ এ দুই মাস বর্ষাকাল। কিন্তু আমাদের দেশে বর্ষার আগমন আগেই ঘটে যায় এবং বর্ষা শেষও হয় দেরিতে। এদেশে সাধারণত জ্যৈষ্ঠ মাসে বর্ষা আরম্ভ হয়ে আশ্বিন মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

 

র্ষার আগমন : গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহের পর অতি ভৈরব হরষে’ সজল গুরুগম্ভীর বর্ষার নব আবির্ভাব। বর্ষা বাংলাদেশের অকিাশে, ও মাটিতে আনে রং ও রসের অফুরন্ত উপহার। সে রূপকথার রাজপুত্রের মতাে ছুটে আসে। তার রথের মর্মরধ্বনি শােনা যায়, তার বাঁকা তলােয়ার ঝলসে ওঠে। এসময় মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর, নদী-নালা, খাল-বিল, জলপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রকৃতির খরতপ্ত দিনের হয় অবসান, মাটির কঠিন বাধা ছিন্ন করে শস্য শিশুর দল আবির্ভূত হয়। তাদের হাতে থাকে নব-অঙ্কুরের জয় পতাকা। আসে পুষ্প বিকাশের লগ্ন। রূপ-রস-বর্ণ-শব্দ-গন্ধ গীতে বর্ষার সমারােহ-উৎসবে বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস ভরে ওঠে। কবি রবীন্দ্রনাথ গেয়েছেন,

এই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে

জলসিঙ্ক্ষিত ক্ষিতিসৌরভরভসে

ঘনগৌরবে নবযৌনা বরষা

শ্যামগম্ভীর সরসা।

 

বর্ষার রূপ : দূরে শ্যামল গ্রাম, আদিগন্ত জল বিস্তারে শস্য-শিশুর নৃত্য, আকাশে কৃষ্ণ ধূসর মেঘবিন্যাস, দিগন্ত বিলাসী বক-পক্ষীর নিরুদ্দেশ যাত্রা। শস্য-বিচিত্রা পৃথিবীর বিস্তৃত প্রান্তরে কৃষকেরা সংগীতে মুখর। আকাশের বুক ফেটে বৃষ্টি নেমে আসে। এমন দিনে ঘরে বসে থাকা ছাড়া কোনাে উপায় নেই। তাই কবি গেয়েছেননীল নব ঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে ওগাে আজ তােরা যাসনে ঘরের বাহিরে। বর্ষাকালে নৌকা, ডিঙি, ভেলা প্রভৃতি চলাফেরা করার জন্য ব্যবহৃত হয়। কৃষকেরা বৃষ্টিতে ভিজে ফসল তােলার কাজে ব্যস্ত থাকে। কারণ বর্ষাকাল পাট কাটার ও ধান চাষের উপযুক্ত সময়।

 

বর্ষার বৈশিষ্ট্য : বর্ষার আকাশ সারাদিন মেঘাচ্ছন্ন থাকে, সূর্যের দেখা মেলে না। নদী-নালা, খাল-বিল, মাঠ-ঘাট সব পানিতে টইটম্বুর থাকে। সারাদিনই অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ে। কবির ভাষায়বাদলের ধারা ঝরে ঝর ঝর আউশের ক্ষেত জলে ভর ভর। কালিমাখা মেঘে ওপারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ চাহিরে। গ্রীষ্মকালের শুষ্ক নদী নিমেষেই ভরে যায়। দু কূল ছাপিয়ে ছলছল করে বয়ে চলে পানি। নদ-নদী সৰ নবযৌবনের রূপ ধারণ করে।

 

বর্ষায় পল্লির অবস্থা : গ্রামের নদী-নালা, ডােবা-পুকুর, খাল-বিল সব পানিতে থৈ থৈ করে। নৌকা ছাড়া চলাচল করা যায় না। রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত হয়ে যায়। ফলে চলাফেরা করতে অসুবিধা হয়। অবিশ্রান্ত বৃষ্টির মধ্যেই কৃষকের মাঠে যায়, গৃহিণীরা গৃহের কাজকর্ম করে। নদীতে মাছ ধরার ধুম পড়ে যায়। খাল-বিলে শাপলা ফুলের সমারােহ দেখা যায়। শহরে বর্ষার অবস্থা। বর্ষায় শহরের নিম্নাঞ্চলগুলাে মাঝে মধ্যে প্লাবিত হয়। বাইরে বের হওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে। তবুও প্রয়ােজনের তাগিদে মানুষকে বাইরে যেতে | যাতায়াতে দুর্ভোগ পােহাতে হয়। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। বিশেষ করে কাঁচা তরকারির দাম বাড়ে। ফলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিতে কষ্ট বেড়ে যায়।

 

বর্ষার উপকারিতা : বর্ষাকালে বৃষ্টির পানিতে সমস্ত ময়লা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়। এসময় তরুলতা, গাছপালা খুব সতেজ হয়ে ওঠে। প্রকৃতিতে দেখা যায় রকমারি ফলের আয়ােজন, বিচিত্র ফুলের সম্ভার। নদীপথের যাতায়াত এবং পরিবহন হয় সহজ-সরল ও প্রশস্ত।

 

বাঙালির অর্থনৈতিক জীবনে বর্ষা : বাংলার কৃষক এ ঋতুতে বীজ বােনে, চারাগাছ তােলে এবং রােপণ করে। বর্ষাই বাংলাকে করেছে শস্য-শ্যামল। বাংলার অন্ন-বস্তু, তার সমস্ত ঐশ্বর্য বর্ষার দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভরশীল। বর্ষা বাঙালির মনােভূমিকেও করেছে সরস ও কাব্যময়। অর্থনৈতিক জীবনে স্বাছন্দ্য বিধান করে সে তার সাংস্কৃতিক জীবনও গঠন করে দিয়েছে। রথযাত্রা, জন্মাষ্টমী, বর্ষামঙ্গল, বৃক্ষরােপণ বর্ষার অবদান।

 

অপকারিতা ; বর্ষার গুরুত্ব যেমন অপরিসীম, তেমনি বর্ষার অপকারিতাও কম নয়। বৃষ্টির পানিতে পল্লির রাস্তাঘাট কাদায় ভরে ওঠে এবং কোনাে কোনাে জায়গা পানিতে ডুবে যায়, চলাচলের অসুবিধা হয়। দিনমজুররা হয় ঘরে আবদ্ধ; তাদের দুঃখের সীমা থাকে না। গরিবের ভাঙা চালা দিয়ে পানি পাড়ে ঘর ভেসে যায়। ময়ুবিজয়ের কেতন উড়িয়ে মেঘের গুরু-গুরু মাদল বালিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে ঝরে পড়ে বর্ষা। উত্তর দিক থেকে নেমে আসে মরণঢালা ভয়ংকরী বন্যা। এসময় দূষিত পানি পানের ফলে কলেরা, টাইফয়েড, আমাশয় প্রভৃতি রােগ মহামারি আকার ধারণ করে।

 

মানমনে বর্ষার প্রভাবঃ বর্ষার মেঘাচ্ছন্ন আকাশের ছায়ায় বনভূমি শ্যামল হয়ে ওঠে। বর্ষা মনকে সহজ, সরল ও সৃষ্টিশীল করে তােলে। মন হয় উদাস। এমন দিনে মন যেন কারাে নিবিড় সান্নিধ্য লাভ করতে চায়। তাই কবি জসীমউদ্দীন বলেছেন

আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন চুল ছল জলধারে

বেনুবানে বায়ু নাড়ে এলােকেশ, মন যেন চায় কারে।

উপসংহার : অপূর্ব রূপশ্রী নিয়ে বর্ষা এদেশে আগমন করে। বর্ষার অপকারের চেয়েও উপকার অনেক বেশি। বর্ষা না হলে আমাদের দেশ মরুভূমিতে পরিণত হতাে। শুধু বর্ষার কারণেই এদেশ সুজলা-সুফলাশস্য-শ্যামলা অনিন্দ্যসুন্দর হয়েছে।

 

বর্ষাকাল সম্পর্কিত আরও রচনা,

 

একটি বর্ষণমুখর সন্ধ্যা

 

এই প্রবন্ধের অনুসরণে লেখা যায়ঃ

এ বর্ষণমুখর সন্ধ্যা

বর্ষণমুখর সন্ধ্যার বর্ণনা

বর্ষণমুখর সকালের অনুভূতি

 

“মম যূথীনে শ্রাবণ মেঘের

সজল পরশ লেগেছে,

তুতুর মন-অঙ্গনে যেন

প্রথম বরযা নেমেছে।” —রবীন্দ্রনাথ

 

ভূমিকা : দৈনন্দিন কর্মমুখর জীবন প্রবাহের গতানুগতিকতার মধ্যে এমন কিছু দিন ও মুহূর্ত আসে যেগুলাে একটা বিশেষ স্বাতন্ত্র ও রসাঘাদে আমাদের মনের মণিকোঠায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে, যা সহজে ভূলা যায় না। জীবনে কত বসন্ত, কত শরৎ তার অপরূপ সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে মনকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে কোনাে এক কল্পনার জগতে, বর্ষা এনেছে জীবনে রােমান্স । এমনি এক বর্ষণমুখর স্বপ্নময় সন্ধ্যা আমার স্মৃতির জগতে অক্ষয় হয়ে আছে।

 

বর্ষণমুখর সকালের অনুভূতি : সকাল থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। মনে হচ্ছিল যেন সন্ধ্যার আঁধার এসেছে ঘনিয়ে। নিত্যদিনের মতাে খােলা জানালার পাশে । বই নিয়ে পড়তে বসেছিলাম। একটু পরেই বৃষ্টি নামলাে। চারদিক আরও ঘন অন্ধকার হয়ে এল। এমন বাদলা দিনে কি পড়ায় মন বসে? কোন এক স্বপ্নপুরীর কল্পনায় মন ভেসে যেতে চায়, রঙিন স্বপ্নের মালা গেঁথে চলে। চেয়ে আছি দূরের কাজল কালাে মেঘের পানে। কবিগুরুর হৃদয়স্পর্শী আবেগ হৃদয়ে এক অপূর্ব অনুভূতি জাগায়— ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে। ময়ূরের মত নাচেরে। কতক্ষণ ধরে কী ভাবছিলাম খেয়াল নেই। হঠাৎ পাশের বাড়ির টেপ রেকর্ডার থেকে ভেসে এল মন উদাস করা রবীন্দ্রসংগীতের সুর-

“মন উড়ে মেঘের সঙ্গী

চলে দিক-দিগন্তের পানে

শ্রাবণ-বরষণ সঙ্গীতে।”

বর্ষা প্রকৃতি যেন নতুন সাজে সজ্জিত হয়েছে। এরই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমার কল্পনাবিলাসী মন মুক্ত বিহঙ্গের মতাে পাখনা মেলে উড়ে চলেছে এক স্বপ্নময় কল্পলােকে। এই বর্ষণমুখর সকালে রাখাল বালকেরা গরুর পাল নিয়ে মাঠে নেমেছে। গাভী হাম্বা রবে বাচ্চা খুঁজে ফিরছে। গ্রাম্যবধূ কলসি নিয়ে চলেছে জলের ঘাটে। খােলা জানালার কাছে সারিসারি গাছগুলাে বরষার জলধারায় প্রাণভরে স্নান করছে আর পাতা নেড়ে প্রাণের আবেগ প্রকাশ করছে। ছােট শালিক পাখিটি ডুমুর গাছের পাতার নিচে বসে একমনে কী যেন ভেবে চলেছে। এমনই বর্ষণমুখর প্রকৃতিকে আরও নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করার বাসনা মনের মধ্যে তীব্র আকার ধারণ করে। মেঘের কালাে ঋপির মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল দিনের সূর্য। মেঘের কালাে ছায়ায়, বৃষ্টিতে, ঝড়ােহাওয়ায়, ঘন ঘন মেঘের গুরু গুরু ডাকে অদ্ভুত

 

বর্ষণমুখর সন্ধ্যার বর্ণনা : সকাল থেকেই অবিরাম বৃষ্টি। সারাদিন পার হয়ে গেল, অথচ বৃষ্টির কমতি বেশি নেই। একইভাবে অশ্রান্ত বর্ষণ। একটা মায়াবী পরিবেশ। গাছের ডালে পাতায় ঝড়োহাওয়া আর বৃষ্টির ফোঁটার চলছিল অবিরাম মাতামাতি। বৃষ্টি বাউল তার একতারা বাজিয়েই চলেছে। আকাশ অঝাের ধারায় কেঁদেই চলেছে। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দের সংগীতে কোথাও ছেদ পড়ে নি। ওগাে আজ তােরা যাসনে ঘরের বাহিরে এমনি করে আটকে থাকার বাধ্যবাধকতা চার দেওয়ালের মাঝে বন্দি করে ফেলেছিল মানুষকে। স্বাভাবিক জীবন হয়ে পড়েছে বিপর্যস্ত। মানুষজন সকলেই ঘরের দিকে ত্রস্তপদে রওয়ানা হয়েছে। কেউ ছাতা মাথায়, কেউ পাতার মাথাল মাথায় দিয়ে, কেউবা খালি মাথায় ছুটে চলেছে। সকাল দুপুরে বেরিয়ে আসা গবাদিপশু গােশালায় ফিরেছে। পাখিরা ফিরেছে তাদের নীড়ে। কিন্তু কোনাে বিহঙ্গের পাখা বন্ধ হয় নি। কবিরা বর্ষার প্রেমিক, এমনকি প্রাবন্ধিকেরাও এর থেকে পিছিয়ে নেই। আমি নিতান্তই ছাত্র। একটানা বৃষ্টি আমার কাছে মােটেই সুখকর নয়। দিনভর বৃষ্টি মানেই দুপুরে ভুনা খিচুড়ি, পড়শীর বাড়ি যেতে হাঁটু কাদা জল, পদে পদে পিছল পথের হুমকি, আর সবচেয়ে নিদারুণভাবে বিকেলে খেলার মাঠে ফুটবল খেলার ইতি। অতএব, সবকিছুর আশা ছেড়ে দিয়ে আগে থেকেই জানালার পাশে বসেছিলাম। পড়ুয়া ছাত্ররা বলে, বৃষ্টির দিনে নাকি অঙ্ক কষে সুখ; সে চেষ্টাও ও একবার করেছিলাম। কিন্তু অঙ্কটা তাে কেবল মস্তিষ্কেরই ব্যাপার নয়, মনও লাগে। বৃষ্টির বেধড়ক অত্যাচারে মনটা এমনই বিরূপ হয়ে আছে যে, কোনাে অঙ্কই মিলবার সম্ভাবনা দেখা গেল না। সুতরাং জানালার ধারে বসে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ শােনা ছাড়া আমার আর কোনাে উপায় ছিল না। বৃষ্টির জন্য দৃষ্টি বেশিদূর প্রসারিত করা গেল না। চোখের ঠিক সামনেই টপটপ করে পানির বড় বড় ফোঁটা পড়ছে চাল গড়িয়ে। আর তার থেকে কিছু দূরেই অঝোর ধারায় সূক্ষ্ম জলকণার বর্ষণ। আমাকে কিন্তু প্রথম ব্যাপারটিই আকৃষ্ট করল বেশি। প্রাকৃতিক বর্ষণের তুলনায় এ পতনের বেশ একটা ছন্দ আছে, নির্দিষ্ট সময় অন্তর এক একটা ফোটার পতন। দূরে গাছপালাগুলাে ঝাপসা হয়ে আছে। সতেজ, সবুজ গাছগুলাে কালচে, ধূসর দেখাচ্ছে, এমনকি পাশের বাড়িটিও দেখা যাচ্ছে না ভালাে করে। দুএকজন লােক হাঁটছে। মাথায় টোপর, সাবধানী লঘু পদক্ষেপ, বৃষ্টির পর্দার আড়ালে চেহারা চিনবার উপায় নেই কারাে। বােধ হয় এসব কিছুই বর্ষণমুখর দিনের সৌন্দর্য। কিন্তু আমি তা গ্রহণে এবং আস্বাদনে অক্ষম। জানালার ধারে কোনাে কদম তরুর দোলায়মান শাখাও নেই। মনের ভেতরে তাই কবি কবি ভাব জাগল না। তবু মনবিহঙ্গ পাখা মেলল কল্পনার আকাশে। যদি ফুটবল খেলা যেত মাঠে গিয়ে কিংবা হা-ডু-ডু। 

সূর্যের মুখ দেখা যায় নি সারাদিন। পুরাে দিনটাতেই ছিল সন্ধ্যার আমেজ। ধীরে ধীরে বৃষ্টির ফোঁটা মিলিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে থেকে। কেবল শব্দ শােনা যেতে লাগল একটানা জল পতনের। সন্ধ্যার অবসান হচ্ছে। পাশের ডােবা থেকে ব্যাঙের প্রমত্ত ডাক শােনা যাচ্ছে। সে যেন এক কনসার্ট। দূরে দেখলাম একটা জোনাকি জ্বলে ওঠল। কিন্তু বৃষ্টির দিনে তাে জোনাকি জ্বলে না। তবে কী? না, লণ্ঠন হাতে কে যেন গােয়ালে গরু বাঁধছে। যারা বাইরে ছিল তারা সকলেই ভেজা দেহে গৃহের অভিমুখে ফিরছে। সমস্ত আকাশ জুড়ে এমনই কালাে মেঘ যেন এক্ষুণি একটা ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হবে। বর্ষণধারা আরও বাড়ল। সেই সঙ্গে বিদ্যুতের আলােকে যেন ত্রিনয়নের আগুন জ্বলে ওঠছে। সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ার তীব্র গতিতে গাছপালাদের উন্মত্ত ঝাঁকুনি, এমনকি বাড়িটাও যেন কেঁপে ওঠল। প্রচণ্ড জোরে বাজ পড়ার শব্দে আতঙ্কিত নৃত্য শুরু হলাে। ঝড় থেমেছে কিন্তু তখনাে বৃষ্টি পড়ছে অবিরাম। বিদ্যুতের চোখ ধাঁধানাে আলাের ঝিলিক, গুরু গুরু মেঘের গর্জন, চারদিকে ঝি ঝি পােকার ডাক। মন মুগ্ধকরা এ এক মােহময় পরিবেশ।.এহেন বর্ষণমুখর দিনের অনুভবের আঘাদ প্রাণ ভরে গ্রহণ করা যায় মনের মণিকোঠায়, স্মৃতির বাসরে স্মরণীয় করে রাখা যায়, কিন্তু স্বরূপটিকে ভাষায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। কবির ভাষায় এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘন ঘাের বরিষায়।

ক্রমেই অন্ধকার গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে এল। এখন আর কিছুই দেখা যায় না। অন্ধকারে সব একাকার। কেবল পাশের বাড়ির রহমান মিয়ার , আযানের শব্দ শােনা যায়। মা এসে হারিকেনটি ধরিয়ে দিলেন এবং যাবার সময় ঘরের জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে গেলেন।

 

উপসংহার : বর্ষণমুখর সন্ধ্যার একটা নিজস্ব রূপ আছে। তা একান্তে অনুভব না করলে তার মহিমা বােঝা যায় না। হৃদয়ের বেদনা স্মৃতিমুখর সন্ধ্যায় বুক ভরে জেগে থাকে। হৃদয় এক অনাবিল আনন্দে ভরে যায়। বিরহী বকুল হৃদয় শাখায় সুবাস ছড়ায়; একটা অলস অতলতা মনের গভীরে না পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তােলে। সে যে কী অনুভূতি, কী যন্ত্রণা বলে বােঝানাে যায় না-

“কী জানি কী হলাে আজি, 

ওরে জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,উথলি উঠছে বারি”-র মতাে।

 

আরও একটি রচনা বর্ষাকাল নিয়ে,

বর্ষা ও বন্যা 

 

“ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে

জলসিএিত ক্ষিতি সৌরভ রভসে।” -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

ভূমিকা : বাংলাদেশে বর্ষার আবির্ভাব যেমন রাজসিক, তার আয়ােজন তেমনি সুবিপুল। কাজল কালাে সজল মেঘের স্তরবিন্যাসে আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত হয়ে যায় অবগুণ্ঠিত। ঋতুরঙ্গের পট বদলে যায়। মেঘের গর্জনে ধ্বনিত হয় মৃদঙ্গের বাদ্য, তলােয়ারের মতােই খরদীপ্ত বিদ্যুৎশিখা আকাশের বক্ষদেশ বিদীর্ণ করে ঝলসে ওঠে, রাজার মতােই মহিমা নিয়ে আসে বর্ষা। এ সময়ে বন্যাও হয়। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও জনসংখ্যা বিস্ফোরণ যেমন বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য, তেমনি প্রতিবছর বন্যাকবলিত হওয়াও বাংলাদেশের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

বর্ষার আগমন : আষাঢ়-শ্রাবণ মাস বর্ষাকালু। তবে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস থেকেই বাংলাদেশে বর্ষা শুরু হয়ে যায়। আকাশের দিগন্তে মেঘের সমারােহ মাঝে মধ্যেই দেখা যায়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বর্ষা যখন আসে, তখন কেবল আমাদের বাইরের আকাশটাই নয়, আমাদের মনের আকাশটাকেও সে তার মেঘমাধুর্যে পরিপূর্ণ করে আনে, অবিশ্রান্ত রসধর্ষণে তাকে কোমল ও সিক্ত করে তােলে।

 

বর্ষার রূপ : বর্ষার আগমনে মিথুশীতল ধারা বর্ষণে রােমাঞ্চ জাগে ধরিত্রীর সর্বাঙ্গে। উদ্যতবাহু অরণ্যের বুকে জেগে ওঠে বহু প্রতীক্ষিত মর্মর মুখর দিনের হয় অবসান। নদীপথে মাঝিমাল্লাদের কষ্ট থেকে শােনা যায় সারিগানের অতার মধ্যে ঘনিয়ে আসে পুষ্পবিকাশের আনন্দঘন পরম উল্লাস। ছিন্ন হয় মাটির কঠিন বাধা। শস্য শিশুর দল নবঅকুরের জয়পতাকা বহন করে ধরাপৃষ্ঠে হয় অবতীর্ণ। চারদিক শ্যামল সৌন্দর্যে লগ্ন। কেয়া-কদম্ব-জুই-গন্ধরাজ-হান্নাহেনার স্নিগ্ধ গন্ধবাহারে, জলের কলােচ্ছাসে, বনের পত্রমর্মরে বর্ষাপ্রকৃতির উন্মুখ হৃদয়ের কী অনবদ্য প্রকাশ। 

 

বর্ষার নানা দিকঃ সজল শ্যামল বর্ষার সঙ্গে আছে বাঙালির প্রাণের সম্পর্ক। তার সারা বছরের খাদ্য উৎপাদনে, তার অর্থনৈতিক জীবন সংগঠনে বর্ষার অবদান অসামান্য। গ্রাম্য পথ কর্দমাক্ত, পঙ্কিল, মাঠে কাদা জলের খেলা, অবিরল ধারাবর্ষণ, বজ বিদ্যুৎ ও ঝড় বন্যার ভয়াল রূপ রােপণ করে। হেমন্তের পরিপূর্ণ খামারে যে রাশি রাশি সােনার ধান তােলা হবে, তার জন্য বর্ষার এই দুরূহ কৃচ্ছ সাধনা। স্নেহময়ী বর্ষাই সমস্ত তুচ্ছ করে বাংলাদেশের আবহমান কালের কৃষক সম্প্রদায় ক্ষুধা তৃষ্ণা ভুলে এ সময় মাঠে মাঠে বীজ বােনে, চারাগাছ তােলে, চারাগাছ বাংলাদেশকে করেছে শস্যশ্যামলা। তার সারা বছরের অন্নবস্ত্র, তার আর্থিক সচ্ছলতা সবকিছুই নির্ভর করে বর্ষার প্রসন্নতা ও দাক্ষিণ্যের ওপর। অতিবর্ষণের ফলে বর্ষা তার স্নেহশালিনী রূপের পরিবর্তে ধারণ করে ভয়াবহ সর্বগ্রাসী রূপ। তখন প্রচণ্ড ঝটিকা ও বন্যার তাণ্ডবে বহু গ্রাম জনপদ ধ্বংস হয়, বহুপ্রাণ মৃত্যুর করালগ্রাসে নিপতিত হয়, ক্ষেতের ফসল এবং কোটি টাকা মূল্যের বহু সম্পদ বিনষ্ট হয়। বর্ষা বাংলার জীবন সাধনা ও ভাব সাধনার অনন্য রূপকার। বাঙালির অর্থনৈতিক জীবনের মতাে সাংস্কৃতিক জীবন গঠনে ও বিকাশে বর্ষার অবদান অপরিসীম। বর্ষা বাঙালির মনকে করেছে সরস ও সৃষ্টিশীল। সে অফুরন্ত ফসল ফলিয়ে বাঙালির হাতে তুলে দেয় অফুরন্ত অবসর ও আর্থিক সংগতি। বাংলা কবিতায় ও গানে পড়েছে আকাশের ঘূর্ণায়মান মেঘের নিগ্ধ সজল ছায়া। কবি জয়দেব থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বর্ষার কবিতা ও সংগীতের যেন অন্ত নেই। বর্যা কেবল বাংলাদেশের মাটিকেই শ্যামল সরস করে নি, সে বাঙালির মনােভূমিকেও করেছে রসসিক্ত। সেই সঙ্গে বর্ষা তার কাব্য দান করেছে চির শ্যামলতা, চির নবীনতা।

 

বন্যা : বন্যা তেমনি দেশের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও জনসংখ্যা বিস্ফোরণ যেমন বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য। প্রতিবছর বন্যাকবলিত হওয়াও বাংলাদেশের একটি বৈশিষ্ট্য। কখনাে কখনাে অত্যধিক বৃষ্টিপাতের ফলে জলস্ফীতি দেখা দেয়, সঙ্গে । নদনদীতেও প্লাবন আসে। বর্ষা আর প্লাবনের এই অস্বাভাবিক অবস্থাই বন্যা। প্রতিবছর খালবিল, নদীনালা, পুকুর ডােবা প্লাবিত হয়ে গ্রামের পর গ্রাম ডুবে যায়। এ সমস্যা দূর করতে না পারলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

 

বন্যার কারণসমূহ : বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদী মেঘনা, যমুনা ও পদ্ম সবগুলােরই উৎপত্তিস্থল ভারত। মূলত এ তিন নদীর পানি প্রবাহের পরিমাণের হ্রাস বৃদ্ধির ওপরই বাংলাদেশের বন্যা নির্ভরশীল। এছাড়া বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত ও হিমালয়ের বরফগলা পানির আধিক্য বাংলাদেশে বন্যা সৃষ্টির অন্যতম কারণ। বাংলাদেশের ভূমির উত্তর থেকে দক্ষিণে ঢালুর পরিমাণ বেশি নয় এবং বাংলাদেশ গড়ে সমুদ্রতটের তুলনায় মাত্র ৪ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। তাই এখানকার নদীগুলাের পলি বহন ক্ষমতা খুবই কম। ফলে প্রতিবছর নদীবক্ষে পলি জমাট হয়ে নদীর গভীরতা কমে যায়। ক্রমবর্ধমান মানুষ সমস্ত নিচু জায়গা ভরাট করে তাতে তৈরি করেছে শহর, নগর ও নতুন নতুন ঘরবাড়ি। ফলে পানিপ্রবাহের অনেক পথ বন্ধ হয়ে গেছে। তাই প্রকৃতিও এর প্রতিশােধ নিচ্ছে বন্যার সৃষ্টি করে। যে বন্যা ছিল স্বাভাবিক, সে বন্যা এখন হয়ে পড়েছে অস্বাভাবিক, নিষ্ঠুর ও নিয়ন্ত্রণাতীত।

 

বন্যায় সৃষ্ট অসুবিধাসমূহ : বন্যা যে আমাদের কত ভয়াবহ অসুবিধা সৃষ্টি করে তা কেবল ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। ভুক্তভােগী ছাড়া বন্যার করুণ রূপ অনুভব করা যায় না। বন্যা যখন তার স্বাভাবিক মাত্রা অতিক্রম করে যায় তখন তার প্রতিক্রিয়া হয় খুবই মারাত্মক জমির ফসল, ঘরবাড়ি তলিয়ে যায়। অনাহারে মানুষ মরে এবং বন্যাপরবর্তী সময়ে ছড়িয়ে পড়ে রােগব্যাধি, কখনাে তা এমন মহামারি আকারে দেখা দেয় যে, মানুষ তখন মানবেতর জীবন যাপন করে।

 

বন্যা সমস্যার সমাধান : বন্যা সমস্যার পুরােপুরি সমাধান অবশ্য সম্ভব নয়; তবে এর ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য বেশ কিছু নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। যেমন যেসব স্থানে বন্যার পানি ১ থেকে ৩ ফুটের মধ্যে অবস্থান করে সেসব স্থানে ঘরবাড়ি বসতি স্থাপন না করে সেখানে প্রতিবছর বন্যার স্বাভাবিক প্রবাহকে প্রবাহিত হওয়ার সুযােগ করে দিতে হবে। অর্থাৎ পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে ছড়িয়ে দিতে হবে। বর্ষা মৌসুমের বাড়তি পানি যেসব নদীনালা, খালবিল, শাখানদী ইত্যাদির মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয় সেগুলাের নিষ্কাশন ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। কারণ, এভাবে বর্ষার অতিরিক্ত পানিকে চারদিকে ছড়িয়ে প্রবাহিত করে বন্যা সমস্যার কিছুটা সমাধান করা যেতে পারে। নদীর উপচানাে পানি যাতে তীরবর্তী এলাকায় প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য স্থানবিশেষে মাটি, পাথর, সিমেন্ট ইত্যাদি ব্যবহার করে সাধারণ বাঁধ নির্মাণ করে বন্যাকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রাকৃতিক কারণে আমাদের দেশের অধিকাংশ নদনদী ভরাট হয়ে নাব্যতা হারিয়ে ফেলে। তাতে বন্যার পানি নদীপথে সাগরে যেতে পারে। প্রয়ােজনীয় খালখনন কর্মসূচি সম্পন্ন করা গেলে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। আর তাহলে বন্যার প্রকোপ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করা সম্ভব হতে পারে।

 

উপসংহার : বর্ষা বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনলেও বন্যা কিন্তু অভিশাপ স্বরূপ। তাই বর্ষা আমাদের কাম্য হলেও বন্যা মােটেই কাম্য নয়। বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বন্যার প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

Leave a Comment