পল্লিজননী কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা

পল্লিজননী কবিতার মূলভাব

‘পল্লিজননী’ কবিতায় কবি রুগ্ণ পরিবেশে অসুস্থ সন্তানের শিয়রে এক পল্লিজননীর সন্তান হারানাের শঙ্কা তুলে ধরেছেন। কবিতায় পল্লি প্রকৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গে একটি দরিদ্র পরিবারের করুণ কাহিনি স্থান পেয়েছে। পুত্রের রােগশয্যার পাশে নিবু নিবু প্রদীপ, চারদিকে বুনাে মশার ভিড়, ডােবার পচা পাতার গন্ধ, ঠান্ডা হাওয়া ইত্যাদি নানা কিছু পল্লিজননীর অসুস্থ পুত্রের ঘুম কেড়ে নেয়। মা রুগ্ণ সন্তানকে চুমাে খায়, সারা গায়ে হাত বুলায়, তার বুকের সমস্ত স্নেহ ঢেলে দিয়ে ছেলেকে ঘুম পাড়াতে চায়। ছেলের সুস্থতার জন্য মানত করে। আল্লাহ, রসুল, পীরের কাছে প্রার্থনা করে অশ্রুসিক্ত হয়। বাঁশবনে কানা কুয়াের ডাক, বাদুড়ের পাখা ঝাপটানি, জোনাকির ক্ষীণ আলােয় শীতের শুভ্র কুয়াশা ইত্যাদি মায়ের কাছে অশুভের ইঙ্গিত বলে মনে হয়। মা বালাই বালাই বলে সেগুলাে দূর করতে চায়। দুরন্ত ছেলে রহিম চাচার ঝাড়-ফুকে সুস্থ হয়েই খেলতে গেলে, মা তখন তাকে একটুও বকবে না বলে অনুমতি নেয়। ছেলের এমন কথায় পল্লিমায়ের পুত্রের নানা আবদারের কথা স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। ছেলের ছােটখাটো বায়না না মিটানাের কথা, আড়ঙের সময় পুতুল কেনার পয়সা না দিতে পারার কথা মনে জাগে। ছেলের পথ্য-ওষুধ কিছুই সে কিনে দিতে পারেনি। ঘরের চালে তুতুমের ডাক শুনে সে দূর দূর করে ছেলের অমজাল তাড়াতে চায়। কিন্তু তার সামনের মহাকাল রাত যেন শেষ হয় না। গ্রামীণ পরিবেশে এক দারিদ্রক্লিষ্ট মায়ের অপত্য স্নেহের অনিবার্য আকর্ষণই ‘পল্লিজননী’ কবিতার মূল বিষয়।

 

পল্লিজননী কবিতার ব্যাখ্যা

» রাত থম থম স্তন্ধ নিঝুম, ঘাের-ঘাের-আন্ধার,

নিশ্বাস ফেলি তাও শােনা যায় নাই কোথা সাড়া কার।

ব্যাখ্যাঃ গভীর রাত। ঘন অন্ধকার। কোথাও একটু আলাে নেই, শব্দ নেই। থমথমে পরিবেশ, নিশ্বাস ছাড়লে তার প্রতিধ্বনিও শােনা যায়। তা ছাড়া অন্য কোনাে শব্দ শােনা যায় না, কোথাও কারও সাড়া পাওয়া যায় না ।

» রুগণ ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা,

করুণ চাহনি ঘুম ঘুম যেন ঢুলিছে চোখের পাতা।

শিয়রের কাছে নিবু নিবু দীপ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলে,

তারি সাথে সাথে বিরহী মায়ের একেলা পরাণ দোলে।

ব্যাখ্যাঃ অসুস্থ ছেলের মাথার কাছে দুখিনী মা জেগে আছে। তার ঘুম ঘুম চোখের করুণ চাহনি সেই পরিবেশকে আরও ভারী করে তুলেছে। ছেলের মাথার কাছে সামান্য দীপশিখা নিবু নিবু করে ঘুরে ঘুরে জ্বলছে। যেকোনাে সময় তা নিভে যাবে। এই অবস্থায় মায়ের হৃদয় সন্তানের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠছে, গভীর বেদনাবােধে দুলে উঠছে।

» ভন ভন ভন জমাট বেঁধেছে বুননা মশকের গান

এদো ভােবা হতে বহিছে কঠোর পচান পাতার ঘ্রাণ।

ছােট কুঁড়েঘর, বেড়ার ফাঁকেতে আসিছে শীতের বায়ু,

শিয়রে বসিয়া মনে মনে মাতা গণিছে ছেলের আয়ু।

ব্যাখ্যাঃ রুগণ ছেলের শিয়রে বসে পল্লিজননী রুগ্ণ পরিবেশটিও অবলােকন করছে। বনের ঝােপঝাড় থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা আসছে, তাদের ভন ভন শব্দ সে শুনতে পাচ্ছে, পচা ডােবা থেকে পচা  পাতার গন্ধ ভেসে আসছে। দরিদ্র মায়ের ছােট কুঁড়েঘরের। বেড়ার ফাক দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে। এমনই পরিবেশে। শীতের রাতে মা মনে মনে ছেলের আয়ু গুনে যাচ্ছে।

» ছেলে কয়, মারে, কত রাত আছে, কখন সকাল হবে,

ভালাে যে লাগে না, এমনি করিয়া কেবা শুয়ে থাকে কবে।

মা কয়, বাছারে! চুপটি করিয়া ঘুমােত একটি বার ,

ছেলে রেগে কয়, “ঘুম যে আসে না কি করিব আমি তার।”

ব্যাখ্যাঃ অসুস্থ ছেলে মাকে ডেকে জানতে চায়– রাত আর কতটুকু বাকি, কখন সকাল হবে, তার আর শুয়ে থাকতে ভালাে লাগে না। ছেলেকে আদর করে মা তাকে ঘুমাতে বলে। কিন্তু ছেলে ঘুমায় না। ঘুম না এলে সে কীভাবে ঘুমাবে?

» পাণ্ডুর গালে চুমাে খায় মাতা। সারা গায়ে দেয় হাত,

পারে যদি বুকে যত স্নেহ আছে ঢেলে দেয় তারি সাথ।

নামাজের ঘরে মােমবাতি মানে, দরগায় মানে দান,

ছেলেরে তাহার ভালাে করে দাও কাঁদে জননীর প্রাণ।

ভালাে করে দাও আলা রসুল ভালাে করে দাও পীর,

কহিতে কহিতে মুখখানি ভাসে বহিয়া নয়ন নীর।

ব্যাখ্যাঃ মা অসুস্থ ছেলের গালে চুমাে খায়। সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। ছেলের সেবা-যত্নে মাতৃহৃদয়ের সমস্ত স্নেহ-মমতা ঢেলে দেয়। রােগাক্রান্ত ছেলের আরােগ্য কামনায় মা নামাজের ঘরে মােমবাতি দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে। আল্লাহ, রসুল, পীরকে ডেকে তার সন্তানকে সুস্থ করে দিতে বলে। ছেলের রােগমুক্তির প্রার্থনা করে তার চোখ জলে ভেসে যায় ।

» বাঁশ বনে বসি ডাকে কানা কুয়াে, রাতের আঁধার ঠেলি,

বাদুড় পাখার বাতাসেতে পড়ে সুপারির বন হেলি।

চলে বুনাে পথে জোনাকি মেয়েরা কুয়াশা কাফন ধরি,

দুঃ ছাই! কিবা শঙ্কায় মার পরাণ উঠিছে ভরি।

যে কথা ভাবিতে পরাণ শিহরে তাই ভাসে হিয়া কোণে,

বালাই বালাই, ভালাে হবে যাদু মনে মনে জাল বােনে।

ব্যাখ্যাঃ গভীর রাতের ঘন অন্ধকার ভেদ করে বাঁশবাগান থেকে কানা কুয়াের ডাক ভেসে আসে, সুপারির বনে বাদুড় পাখা ঝাপটায়, কুয়াশার মধ্যে বনের পথে জোনাকি পােকা উড়ে যায়। এসব দেখে-শুনে মায়ের মন শঙ্কায় ভরে ওঠে। সে কথা ভাবতে গেলে মায়ের হৃদয় কাঁপে। সে কথাই তার মনের কোণে বারবার জেগে ওঠে। মা বালাই বালাই বলে সেব অমঙ্গল তাড়াতে চায়। তার সােনামণি, জাদুমণি ভালাে হয়ে যাবে মনে মনে সে স্বপ্নের জাল বােনে।

» ছেলে কয়, মাগাে, পায়ে পড়ি বল ভালাে যদি হই কাল,

করিমের সাথে খেলিবারে গেলে দিবে না তুমি গাল।

আচ্ছা মা বলাে, এমন হয় না রহিম চাচার ঝাড়া,

এখনি আমারে এত রােগ হতে করিতে পারে ত খাড়া?

মা কেবল বসি রুগণ ছেলের মুখ পানে আঁখি মেলে,

ভাসা ভাসা তার যত কথা যেন সারা প্রাণ দিয়ে গেলে।

ব্যাখ্যাঃ ছেলের চোখে ঘুম নেই, সে মাকে বলে কাল যদি সে ভালাে, হয়ে যায় তাহলে করিমের সঙ্গে খেলতে গেলে মা যেন তাকে আর বারণ না করে। আবার বলে– এখনই সে সব রােগ থেকে মুক্ত হয়ে, সুস্থ হয়ে যেতে পারে, উঠে দাড়াতে পারে, এমন ঝাড়া কি রহিম চাচা দিতে পারে না? ছেলের কোনাে কথার উত্তর না দিয়ে কেবল তাকিয়ে থাকে। ভাসা ভাসা কথাগুলাে মা অন্তর দিয়ে অনুভব করে।

» শােন মা, আমার লাটাই কিন্তু রাখিও যতন করে,

রাখিও ট্র্যাপের মােয় বেঁধে তুমি সাত-নরি সিকা ভরে।

খেজুরে গুড়ের নয়া পাটালিতে হুড়ুমের কোলা ভরে।

ফুলঝুরি সিকা সাজাইয়া রেখাে আমার সমুখ পরে।

ছেলে চুপ করে, মাও ধীরে ধীরে মাথায় বুলায় হাত,

বাহিরেতে নাচে জোনাকি আলােয় থম থম কাল রাত।

ব্যাখ্যাঃ ছেলে মাকে তার লাটাই’ যত্ন করে রেখে দিতে বলে। সাত নরি সিকা ভরে ঢ্যাপের মােয়া বেঁধে রাখতে বলে। হুজুমের  কোলা ভরে খেজুরের পাটালি গুড় রাখতে বলে। তার সামনে ফুলঝুরি শিকায় সেগুলাে সাজিয়ে রাখতে বলে। বলতে বলতে ছেলে চুপ হয়ে যায়। মা ছেলের মাথায় হাত বুলায় । কুঁড়েঘরের বাইরে জোনাকির আলােতে স্তব্ধ রাত চলতে থাকে।

» রুগণ ছেলের শিয়রে বসিয়া কত কথা পড়ে মনে,

কোন দিন সে যে মায়েরে না বলে গিয়াছিল দূর বনে।

সাঝ হয়ে গেল তবু আসে নাকো, আইঢাই মার প্রাণ,

হঠাৎ শুনিল আসিতেছে ছেলে হর্ষে করিয়া গান।

এক কোঁচ ভরা বেথুল তাহার ঝামুর ঝুমুর বাজে,

ওরে মুখপােড়া কোথা গিয়াছিলি এমনি এ কালি সাঁঝে।

ব্যাখ্যাঃ অসুস্থ ছেলের মাথার কাছে বসে মায়ের নানা কথা মনে পড়ে। মাকে না বলে ছেলে দূর বনে গিয়েছিল, সঁঝ হয়ে এলাে কিন্তু ছেলে এলাে না। মায়ের মন তখন অস্থির। হঠাৎ সে শুনল ছেলে মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে ঘরে ফিরছে। তার কেঁচর ভর্তি বেথুল, তাই ঝামুর ঝুমুর করে বেজে চলছে। ছেলেকে সে কাছে পেয়ে মুখপােড়া’ বলে কালি সাঝে কোথায় গিয়েছিল তা জানতে চেয়ে আদর মাখানাে শাসন করেছিল।

» কত কথা আজ মনে পড়ে তার, গরীবের ঘর তার,

ছােটখাট কত বায়না ছেলের পারে নাই মিটাবার।

আড়ঙের দিনে পুতুল কিনিতে পয়সা জোটেনি তাই,

বলেছে আমরা, মোসলমানের আড়ঙ দেখিতে নাই।

ব্যাখ্যাঃ কত কথা আজ মায়ের মনে উদয় হচ্ছে। অভাবের সপােরে। সে যে ছেলের ছােটখাটো আবদারও রক্ষা করতে পারেনি সে কথাও তার মনে পড়ছে। মেলার সময় ছেলে পুতুল কিনতে পয়সা চেয়েছিল, মা দিতে পারেনি। উল্টো তাকে বুঝিয়েছিল। আমরা মুসলমান, আমাদের মেলায় যেতে নেই।

» করিম সে গেল? আজিজ চলিল? এমনি প্রশ্ন মালা,

উত্তর দিতে দুখিনী মায়ের দ্বিগুণ বাড়িত জ্বালা।

আজও রােগে তার পথ্য জোটে নি, ওষুধ হয়নি আনা,

ঝড়ে কাঁপে যেন নীড়ের পাখিটি জড়ায়ে মায়ের ডানা।

ঘরের চালেতে হুতুম ডাকিছে, অকল্যাণ এ সুর,

মরণের দূত এলাে বুঝি হায়, হাঁকে মায়, দূর-দূর।

ব্যাখ্যাঃ মায়ের কথায় ছেলে যুক্তি দেখায়, করিম গিয়েছে, আজিজ যাচ্ছে। তা হলে সে যেতে পারবে না কেন? ছেলের প্রশ্নের উত্তর দিতে মায়ের মনে অভাবের যন্ত্রণার জ্বালা ধরে যেত । আজও সে অসুস্থ ছেলের জন্য পথ্য জোটাতে পারেনি, ওষুধ আনতে পারেনি। ঝড়ের সময় পাখির বাসায় কাঁপতে থাকা পাখিটির মতাে ছেলেটি মায়ের বুকে কাঁপছে। ঘরের চালে হুতুম পাখি অকল্যাণ সুরে ডাকছে। মা সেটিকে দূর দূর তাড়াতে চাইছে।

» পচা ডােবা হতে বিরহিনী ডাক ডাকিতেছে ঝুরি ঝুরি,

কৃষাণ ছেলেরা কালকে তাহার বাচ্চা করেছে চুরি।

ফেরে ভন্ ভন্ মশা দলে দলে, বুড়ো পাতা ঝরে বনে,

ফোটায় ফোঁটায় পাতা-চোয়া জল ঝরিছে তাহার সনে।

রুগণ ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা,

সম্মুখে তার ঘাের কুটি মহাকাল রাত পাতা।

পার্শে জ্বলিয়া মাটির প্রদীপ বাতাসে জমায় খেল;

আঁধারের সাথে যুঝিয়া তাহার ফুরায়ে এসেছে তেল।

ব্যাখ্যাঃ পচা ডােবা থেকে ডাহুক ডাকছে। কৃষাণ ছেলেরা গতকাল তার বাচ্চা চুরি করেছে। আবার সেই বুননা মশা ভনভন করছে। গাছ থেকে বুড়াে পাতা ঝরে পড়ছে। সেই সঙ্গে পাতা-ছুঁয়ে ফোটায় ফোটায় পড়ছে কুয়াশায় জমা জল। অসুস্থ ছেলের মাথার কাছে বসে দুখিনী মা জেগে আছে। তার সামনে অন্ধকার গভীর রাত মহাকাল হয়ে পড়ে আছে। দীর্ঘ রাতের গভীর অন্ধকারে আলাে ছড়াতে ছড়াতে প্রদীপের তেল ফুরিয়ে এসেছে। মায়ের মনে ছেলেকে ঘিরে দুর্ভাবনার শেষ নেই।

Leave a Comment