জুতা আবিষ্কার কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা

জুতা আবিষ্কার কবিতার মূলভাব

ধুলাবালি থেকে নিজের পা দুটি মুক্ত রাখার জন্য রাজা তার মন্ত্রীদের ডেকে রাজ্য থেকে ধুলাবালি দূর করার নির্দেশ দেন। এই সমস্যার সমাধান নিয়ে ভাবতে ভাবতে খাওয়া-দাওয়া, ঘুম হারাম হয়ে গেল মন্ত্রী ও পণ্ডিতদের। তাদের পরিবারে কান্নাকাটির রােল পড়ে গেল। রাজা তাদের তােষামুদি কথা শুনতে নারাজ। আদেশ অনুযায়ী কাজ তার চাই। রাজ্যের জ্ঞানী-গুণীদের পরামর্শে সাড়ে সতেরাে লক্ষ ঝাঁটার ঝাটের ফলে রাজ্য ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে এবং সর্দি-কাশিতে মরার উপক্রম হলাে লােকজন। এই ধুলা দূর করতে ভিস্তি ভিস্তি পানি ঢালার ফলে পুকুর, নদী শুকিয়ে গেল আর সর্দি-জ্বরে উজাড় হলাে দেশটা । আবার বসল পরামর্শ সভা। রাজ্য মাদুর দিয়ে ঢেকে দিয়ে রাজাকে ঘরের মধ্যে বন্ধ করে রাখার সিদ্ধান্ত হলাে। রাজা তাতে বাদ সাধলেন। তখন যােগ্যমতাে চামার খুঁজে আনতে লােকজন ছােটাছুটি শুরু করল। বৃদ্ধ চর্মকার রাজার চরণ দুটি চামড়া দিয়ে ঢাকার পরামর্শ দিলেন এবং বৃদ্ধ সেইমতাে রাজার পদযুগল চর্ম আবরণ দিয়ে ঢেকে দিলেন। ধুলাবালি থেকে রাজার পা দুটি মুক্ত হলাে। এভাবেই জুতার আবিষ্কার হলাে।

জুতা আবিষ্কার কবিতার ব্যাখ্যা

» কহিলা হবু, শুন গাে গােবুরায়,

কালিকে আমি ভেবেছি সারা রাত্র

তােমরা শুধু বেতন লহ বাটি,

রাজার কাজে কিছুই নাহি দৃষ্টি।

ব্যাখ্যাঃ মানুষের মনে হঠাৎ করেই কোনাে একটি চিন্তার উদয় হয়। মানুষ তা নিয়ে রাত-দিন ভাবে। রাজা হবুর মনেও তেমন একটি চিন্তার উদয় হয়। তিনি তার মন্ত্রী গােবুরায়কে ডেকে সে কথা বলেন। তিনি মন্ত্রীকে বলেন, রাজসভার সবাই শুধু শুধু বেতন নেয়, কোনাে কাজের দিকে তাদের নজর নেই। রাজা সারা রাত ধরে ভেবেছেন যদি সবাই রাজার কাজের দিকে দৃষ্টি দিত তাহলে ধরণির মাঝে পা ফেলা মাত্র তার পায়ে মলিন ধুলা লাগত না।

» ‘আমার মাটি লাগায় মােরে মাটি,

রাজ্যে মাের একি এ অনাসৃষ্টি!

শীঘ্র এর করিবে প্রতিকার,

নহিলে কারাে রক্ষা নাহি আর।

ব্যাখ্যাঃ রাজা হবু তার রাজ্যের মালিক। আমার মাটি বলে তিনি তার রাজ্যের মাটিকে বুঝিয়েছেন। ধরণির মাঝে রাজা পা দিলে এ মাটিতে তার পা নােংরা হয় । রাজা এ অনাসৃষ্টির প্রতিকার করতে বলেন মন্ত্রীকে। যদি তা মন্ত্রী বা সভাসদরা করতে ব্যর্থ হন তবে রাজা কাউকেই ক্ষমা করবেন না, সবাইকে শাস্তি দেবেন।

» শুনিয়া গােবু ভাবিয়া হলাে খুন,

দারুণ ত্রাসে ঘর্ম বহে গাত্রে।

ব্যাখাঃ পায়ে ধুলা যাতে না লাগে মন্ত্রীকে সেই ব্যবস্থা করতে বলেছেন রাজা হবু। যদি মন্ত্রী বা সভাসদরা এর প্রতিকার করতে না পারেন তবে রাজা সবাইকে শাস্তি দেবেন বলে ঘােষণা দেন। এই কথা শুনে মন্ত্রী গােবুরায় ভেবে ভেবে খুন হন। ভীষণ ভয়ে তার গা থেকে ঘাম ঝরে পড়ে।

» পন্ডিতের হইল মুখ চুন,

পাত্রদের নিদ্রা নাহি রাত্রে।

ব্যাখ্যাঃ রাজার আদেশ শােনার পর রাজ্যের পণ্ডিতের মুখ ভয়ে চুন হয়ে যায়। রাজ্যের পাত্রদের অর্থাৎ সভাসদদের রাতে ঘুম আসে না ভয়ে।

» রান্নাঘরে নাহিকো চড়ে হাঁড়ি,

কান্নাকাটি পড়িল বাড়ি-মধ্যে,

যদি না ধুলা লাগিৰে তব পায়ে,

পায়ের ধুলা পাইব কী উপায়ে।

ব্যাখ্যাঃ রাজা হবুর আদেশ শুনে রান্নাঘরে রান্না বন্ধ হয়ে যায়। বাড়ির মধ্যে স্ত্রী-কন্যারা কান্নাকাটি শুরু করে। মন্ত্রী গােবুর পাকা দাড়ি চোখের জলে ভাসে। তিনি কেঁদে কেঁদে রাজার পায়ের কাছে বসে বলেন, রাজা মশাই, আপনার পায়ে যদি ধুলা না লাগে তবে আমরা আপনার পায়ের ধুলা পাব কীভাবে?

» শুনিয়া রাজা ভাবিল দুলি দুলি,

কহিল শেষে, কথাটা বটে সত্য

কিন্তু আগে বিদায় করাে ধূলি,

ভাবিয়াে পরে পদধূলির তত্ত্ব।

ব্যাখ্যাঃ মন্ত্রীর কথা শুনে রাজা দুলে দুলে বলেন, কথাটা অবশ্য সত্য। কিন্তু আগে ধুলা বিদায় করতে হবে। পদধূলির তত্ত্ব পরে ভেবে দেখা যাবে।

» ধুলা-অভাবে না পেলে পদধুলা

তােমরা সবে মাহিনা খাও মিথ্যে,

আগের কাজ আগে তাে তুমি সারাে,

পরের কথা ভাবিয়াে পরে আরাে।

ব্যাখ্যাঃ রাজা মন্ত্রীকে বলেন, ধুলার অভাবে যদি পদধুলা না পাওয়া যায় তবে তারা কাজের কাজ না করে অযথা বেতন নেয়। এর যদি প্রতিকার রাজ্যের উপাধি-ধরা বৈজ্ঞানিকরা না করতে পারে তবে তিনি এত দিন কেন তাদের পেছনে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করলেন? মন্ত্রীকে তিনি বলেন, আগের কাজ আগে করাে। পরের কথা পরে ভেবাে।

» আঁধার দেখে রাজার কথা শুনি,

যতনভরে আনিল তবে মন্ত্রী

যেখানে যত আছিল জ্ঞানী গুণী

দেশে বিদেশে যতেক ছিল যন্ত্রী।

ব্যাখ্যাঃ রাজার কথা শুনে মন্ত্রী চারদিকে আঁধার দেখতে লাগলেন। মন্ত্রী তাই যত্ন করে দেশ-বিদেশে যেখানে যত জ্ঞানী-গুণী ও যন্ত্রী ছিল তাদের খুঁজে আনেন, যাতে রাজার আদেশ পূরণ

করতে পারেন।

» বসিল সবে চশমা চোখে আঁটি

ফুরায়ে গেল উনিশ পিপে নস্য,

কহিল রাজা, তাই যদি না হবে,

পণ্ডিতেরা রয়েছ কেন তবে?

ব্যাখাঃ রাজার আদেশ পালন করতে মন্ত্রী দেশ-বিদেশ থেকে জ্ঞানীগুণী-যন্ত্রীদের নিয়ে আসেন। তারা চোখে চশমা এঁটে আলোচনায় বসেন। আলােচনা করতে করতে উনিশ পিপে নস্যি ফুরিয়ে যায়। অনেক ভেবে তারা জানতে চান, যদি রাজ্য থেকে ধুলা-মাটি বিদায় করা হয় তবে কোথায় শস্য হবে? উত্তরে রাজা বলেন, যদি মাটির অভাবে শস্য না হয় তাহলে পণ্ডিতেরা রয়েছে কেন? তারা এর প্রতিকার করবে।

» সকলে মিলি যুক্তি করি শেষে

কিনি আঁটা সাড়ে-সতেরাে লক্ষ,

কহিল রাজা, করিতে ধূলা দূর,

জগৎ হলাে ধুলায় ভরপুর।

ব্যাখ্যাঃ জ্ঞানী-গুণী ও পণ্ডিতরা মিলে শেষ পর্যন্ত ধুলামুক্ত করতে যুক্তি  করলেন ঝাঁট দেওয়া হবে রাজ্য। এ জন্য কেনা হলাে সাড়ে সতেরাে লক্ষ ঝাটা। সবাই একসঙ্গে ঝাট দেওয়া শুরু করলে  ধুলা এসে রাজার মুখ, বুক ভরিয়ে দিল। ধুলা এমনভাবে  চারদিকে উড়তে লাগল যে কেউ চোখ মেলে তাকাতে পারল না। ধুলার মেঘের আড়ালে আকাশের সূর্য টাকা পড়ল। লােকে  কাশতে কাশতে অস্থির হয়ে উঠল । অবস্থা দেখে রাজা বলেন,  ধুলা দূর করতে গিয়ে জগৎ হলাে ধুলায় ভরপুর ।

» তখন বেগে ছুটিল ঝাঁকে-ঝাক

মশক কাঁখে একুশ লাখ ভিস্তি।

কহিল রাজা, “এমনি সব গাধা

ধুলারে মারি করিয়া দিল কাদা!”

ব্যাখ্যাঃ ধুলা তাড়াতে গিয়ে যখন সারা রাজ্য ধুলায় পরিপূর্ণ তখন একুশ লাখ ভিস্তি কাখে পুকুর ও নদী থেকে জল নিয়ে আসে ধুলা দূর করতে। এতে সব জল শেষ হয়ে যায়। জলের জীব জল ছাড়া মরে যায়। চারদিকে শুধু পাক আর পাঁক। সর্দি জ্বরে সারা দেশ উজাড় হয়। রাজা বলেন, সবাই এমনি গাধা যে ধুলা দূর করতে গিয়ে সারা দেশ কাদায় পরিণত করল । 

» আবার সবে ডাকিল পরামর্শে,

বসিল পুনঃ যতেক গুণবন্ত

কহিল, মহী মাদুর দিয়ে ঢাকো,

ফরাস পাতি করিব ধুলা বন্ধ।

ব্যাখ্যাঃ আবার সবাই পরামর্শ করতে বসলেন। রাজ্যের যত জ্ঞানী-গুণীর মাথা ঘুরল, চোখে তারা শর্ষে অর্থাৎ অন্ধকার দেখলেন। কিন্তু ধুলার কী হবে তার কোনাে সমাধান কেউ  করতে পারেন না। একজন বলেন পৃথিবী মাদুর দিয়ে ঢাকো, ফরাস পেতে ধুলা বন্ধ করব।

» কহিল কেহ, ‘রাজারে ঘরে রাখাে,

কোথাও যেন থাকে না কোনাে সন্ত্র!

মাটির ভয়ে রাজ্য হবে মাটি

দিবস-রাতি রহিলে আমি বন্ধ ।

ব্যাখ্যাঃ কেউ কেউ বললেন, রাজাকে ঘরের ভেতর রাখা হােক। সে ঘরের কোথাও কোনাে ছিদ্র যেন না থাকে। রাজা যদি ধুলায় পা না দেন, সব সময় ঘরে থাকেন তবে তার পায়ে ধুলা লাগবে না। রাজা সে কথা শুনে বলেন, এ কথা খাটি, কিন্তু আমার মনে সন্দেহ হচ্ছে মাটির ভয়ে আমি যদি ঘরের বাইরে আসি তবে রাজ্য হবে মাটি। কারণ তিনি রাত-দিন ঘরের মধ্যে বন্ধ থাকলে রাজ্যের কাজ পরিচালনা করবেন কে?

» কহিল সবে, চামারে তবে ডাকি

চর্ম দিয়া মুড়িয়া দাও পৃথ্বী।

কহিল সবে, হবে সে অবহেলে,

যােগ্যমতাে চামার যদি মেলে।

ব্যাখ্যাঃ সবাই তখন বলেন, তাহলে চামারকে ডাকি। সে চামড়া দিয়ে সমস্ত পৃথিবী মুড়িয়ে দেবে। ধুলার পৃথিবী চামড়ার ঝুলির মধ্যে ঢেকে রাখি তাহলে ধুলাও দূর হবে আর মহারাজার মহাকীর্তিও রবে। সবাই বললেন, তা হতে পারবে তখন, যদি যােগ্য চামার খুঁজে পাওয়া যায়।

» রাজার চর ধাইল হেথা হােথা,

ছুটিল সবে ছাড়িয়া সব কর্ম।

যােগ্যমতাে চামার নাহি কোথা,

মিলে এত উচিত-মতাে চর্ম।

ব্যাখ্যাঃ রাজার চর এখানে সেখানে যায় চামড়া ও চামারের খোঁজে। কিন্তু যােগ্য চামার কোথাও পায় না। এ কাজের জন্য প্রয়ােজনীয় চামড়াও কোথাও মেলে না।

» তখন ধীরে চামার-কুলপতি

কহিল এসে ঈষৎ হেসে বৃদ্ধ,

কহিল রাজা, ‘এত কি হবে সিধে!

ভাবিয়া ম’ল সকল দেশসুদ্ধ

ব্যাখ্যাঃ যখন চামার আর চামড়ার জন্য চর চারদিকে ছােটাছুটি করছে তখন চামার কুলপতি আসেন। বৃদ্ধ সামান্য হেসে রাজার কাছে কিছু বলার অনুমতি প্রার্থনা করেন। বলেন, সহজে সমাধান হবে যদি রাজা নিজের দুটি চরণ ঢেকে রাখেন। তাহলে আর ঢাকতে হবে না পৃথিবী । রাজা বলেন, এত কি সহজ, অথচ ভেবে মরল দেশের সব মানুষ।

» মন্ত্রী কহে, “বেটারে শূল বিধে

কারার মাঝে করিয়া রাখাে রুদ্ধ।

সেদিন হতে চলিল জুতা পরা

বাঁচিল গােৰু, রক্ষা পেল ধরা।

ব্যাখ্যাঃ চামার কুলপতির কথা শুনে মন্ত্রী বলেন, বেটাকে শূলে বিধে কারাগারে রুদ্ধ করে রাখাে। বুড়াে চামার তখন রাজার পায়ের কাছে বসে রাজার পা চামড়ার আবরণ দিয়ে ঢেকে দিলেন। মন্ত্রী বললেন, চামারের বুদ্ধিটা তারও মনে ছিল, কেমন করে বেটা চামার তা জানতে পেরেছে। সেদিন থেকে শুরু হলো জুতা পরা । বাচলেন গােবুরায়, রক্ষা পেল পৃথিবী।

Leave a Comment