স্বাধীনতা, এ শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো কবিতার মূলভাব
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের বিশাল জনসভায় বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। এটা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের নিগড় থেকে বাঙালির মুক্তির উদাত্ত আহ্বান। আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ভাষণের মাধ্যমেই সূচিত হয়। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে তাঁর ভাষণ শােনার জন্য বাংলার সর্বস্তরের মানুষ একত্র হয়েছিল। সবার উদ্দেশ্য ছিল তাদের প্রিয় নেতার কাছে স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা শােনার আকুলতা। রমনার রেসকোর্সে যেখানে সেদিনের তৈরি হয়েছিল সেখানে এখন গড়ে উঠেছে শিশুপার্ক। কবি মনে করেন, অনাগত কালের শিশুদের কাছে এ কথাটি জানিয়ে দেওয়া দরকার যে, এখান থেকেই, এই পার্কের মঞ্চ থেকেই বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় শব্দ ‘স্বাধীনতা’ কথাটি উচ্চারিত হয়েছিল, আর তা উচ্চারিত হয়েছিল তাদের প্রিয় মানুষটির মুখ থেকে। আপামর জনতার সামনে তিনি সেদিন এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর বজ্রকণ্ঠ নিয়ে। তিনি বাঙালির বড় প্রিয় মানুষ, বাঙালির শেকড় থেকে জেগে ওঠা এক বিদ্রোহী নেতা। তিনি সাধারণ কোনাে রাজনীতিবিদ নন, তিনি ছিলেন রাজনীতির কবি। এদেশের মানুষের ভালােবাসায় গড়া এক অসাধারণ মানুষ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মতাে দৃপ্ত পায়ে মঞ্চে এসে সেদিন বিকেলের পড়ন্ত রােদে ডাক দিয়েছিলেন- “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” উচ্চারণের মাধ্যমে। সেদিন থেকেই বাঙালির কাছে স্বাধীনতা শব্দটি অত্যন্ত প্রিয় শব্দ।
- স্বাধীনতা, এ শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর
- স্বাধীনতা, এ শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো কবিতার জ্ঞান ও অনুধাবনমূলক প্রশ্ন ও উত্তর
স্বাধীনতা, এ শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো কবিতার ব্যাখ্যা
» একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে।
ডাের থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: কখন আসবে কবি?
ব্যাখ্যাঃ ভাের থেকেই দারুণ উত্তেজনায় লক্ষ লক্ষ মানুষ অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে একটি কবিতা তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শােনার জন্য। কখন তিনি আসবেন, কখন তিনি তাঁর সেই অমর কবিতাখানি শােনাবেন। এই কবি হচ্ছেন বাংলার মানুষের, অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর কবিতা হচ্ছে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে রেসকোর্সের মাঠে দেওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ। এই ভাষণ শােনার জন্যই সকাল থেকে এদেশের মুক্তিপাগল লক্ষ লক্ষ মানুষ সেদিন অপেক্ষায় ছিল।
» এই শিশু পার্ক সেদিন ছিল না,
এই বৃক্ষে ফুলে শােভিত উদ্যান সেদিন ছিল না,
এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না।
তা হলে কেমন ছিল শিশু পার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে, ফুলের বাগানে
ঢেকে দেয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি?
ব্যাখ্যাঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন রেসকোর্স ময়দানের পরিচয় দিচ্ছেন কবি, তিনি বলছেন, আজকের মতাে শিশুপার্ক, গাছপালা, ফুলের সৌন্দর্য এসবের কোনাে কিছুই সেদিন এ মাঠে ছিল না। আজকের মতাে এমন ঘুম ঘুম বিবর্ণ বিকেলও সেদিন ছিল না। এটি ছিল সবুজ ঘাসে ছাওয়া বিস্তীর্ণ সবুজে সবুজময়।
» জানি, সেদিনের সব স্মৃতি মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত
কালাে হাত। তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ
কবির বিরুদ্ধে কবি,
মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ,
বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল,
উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান,
মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ…।
ব্যাখ্যাঃ সেদিনের সব স্মৃতিচিহ্ন মুছে দিতে একদল মানুষ যে নানা অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে কবি তা জানেন। তারা ঢাকার প্রাণকেন্দ্র সেই মাঠখানির স্মৃতি ম্লান করে দিতে, নানা আয়ােজন করছে। যেদিন মহান কবি সেখানে দাড়িয়ে জাতিকে মুক্তির কবিতা শুনিয়েছিলেন, সেদিন সেখানে শিশুপার্ক ছিল না। কালাে হাত, সেই স্মৃতি মুছে দিতেই এসব স্থাপনা গড়ে তুলেছে। আজ অশুভ শক্তির যে উত্থান ঘটেছে। তাতে সব ইতিবাচক ভাবনা, সৌন্দর্য ও কল্যাণ ধ্বংস করার প্রয়াস চলছে। শত্রুরা এ ধ্বংসের শুরু করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে। তারা আজ শুভ চিন্তার বিরুদ্ধে অশুভ চিন্তাকে দাড় করছে। উন্মুক্ত উদ্যানের বিরুদ্ধে তারা নিজেদের স্বার্থের উদ্যান গড়ে তুলছে। তারা ইতিহাসের সত্যের বিরুদ্ধে মিথ্যার জাল বিস্তার করছে।
» হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি,
শিশু পার্কের রঙিন দোলনায় দোল খেতে খেতে তুমি
একদিন সব জানতে পারবে; আমি তােমাদের কথা ভেবে
লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প।
সেদিন এই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর।
ব্যাখ্যাঃ যে শিশুর জন্ম হয়নি, যারা একদিন জন্ম নেবে, তাদের মাঝখান থেকে কেউ কেউ সাহসী চেতনার প্রতীক হবে। তারা এই উদ্যানের সেদিনের সেই ইতিহাস শিশুপার্কের রঙিন দোলনায় দোল খেতে খেতে জানতে পারবে। কবি তাদের সেই সুযােগ করে দিয়ে যাচ্ছেন। কারণ তিনি সেসব শিশুর কথা ভেবেই সেই দিনের, সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প লিখে রেখে যাচ্ছেন। সেই বিকেলটি ছিল ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের বিকেল। সেদিন এই মাঠের রূপ ভিন্ন ছিল।
» না পার্ক না ফুলের বাগান,- এসবের কিছুই ছিল না,
শুধু একখন্ড অখণ্ড.আকাশ যেরকম, সেরকম দিগন্ত প্লাবিত
শুধু মাঠ ছিল দূর্বাদলে ঢাকা, সবুজে সবুজময়।
আমাদের স্বাধীনতা প্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশেছিল
এই ধু ধু মাঠের সবুজে।
ব্যাখ্যাঃ সেদিন এখানে কোনাে পার্ক, ফুলের বাগান এসব কিছুই ছিল না। শুধু আকাশের মতাে দিগন্ত প্লাবিত একটা খােলা মাঠ ছিল। সবুজ দূর্বা ঘাসে ঢাকা মাঠটি ছিল সবুজে সবুজময়। সেদিন এখানে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের সবুজ আর এদেশের মানুষের প্রাণের সবুজ মিলেমিশে একাকার হয়েছিল।
» কপালে কজিতে লালসালু বেঁধে
এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লােহার শ্রমিক,
লাঙল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক,
হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত,
নিম্নবিত্ত, করুণ কেরানি, নারী, বৃদ্ধ, ভবঘুরে
আর তােমাদের মতাে শিশু পাতা-কুড়ানিরা দল বেঁধে।
ব্যাখ্যাঃ সেদিন এই সবুজ মাঠে ছুটে এসেছিল কৃষক-শ্রমিকসহ নানা পেশার মানুষ। লােহার কারখানার শ্রমিক এসেছিল কপালেকজিতে লালসালু বেঁধে। কৃষক এসে কাঁধে লাঙল নিয়ে। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, নারী, বৃদ্ধ, ভবঘুরে, কেরানি সবাই এসে জড়াে হয়েছিল এই মাঠে। সেদিন পাতা-কুড়ানিরাও দল বেঁধে এসেছিল, যারা ছিল তােমাদের মতাে শিশু। মৃত্যুভয়হীন এসব মানুষের চোখে-মুখে ছিল মুক্তির স্বপ্ন, অধিকারের দাবি।
» একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্য কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের : কখন আসবে কবি?’ ‘কখন আসবে কবি?’
ব্যাখ্যাঃ সেখানে সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল কবিতা শােনার জন্য। কখন সেই কবিতা নিয়ে কবি আসবেন সবাই সেদিকে তাকিয়ে ছিল। কবি কখন আসেন, কখন আসেন কবি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এখানে কবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
» শত বছরে শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতাে দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মতাে দাঁড়ালেন।
ব্যাখ্যাঃ তারপর শত বছরের শত সংগ্রামের পথ ধরে কবি এগিয়ে এলেন। সেই সংগ্রামী ইতিহাস তার হৃদয়ে গাঁথা ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশির প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হওয়ার ঘটনা, ১৮৫৭ সালের ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন- সিপাহি বিপ্লব, ১৯৩০ সালের মাস্টার দা সূর্য সেনের নেতৃত্বে ব্রিটিশবিরােধী সশস্ত্র যুদ্ধের ঘটনা, ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন প্রভৃতির মধ্য দিয়ে কবি এগিয়ে এলেন। তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মতাে গভীর মননে দীপ্ত এবং দৃপ্ত পদভারে বক্তৃতার মঞে এসে দাড়ালেন বহু প্রতীক্ষিত লাখ লাখ মানুষের সামনে।
» তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খােলা। কে রােধে তাহার বকণ্ঠ বাণী?
ব্যাখ্যাঃ তাকে দেখেই সমবেত জনতা আনন্দে, আবেগে লাফিয়ে উঠল- জনসমুদ্রে প্রাণে জোয়ার শুরু হলাে। জনতার সেই জোয়ারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার দ্যুতিময় বাণী তুলে ধরলেন। তখন বাধার সব দুয়ার খুলে গেল।
» গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শােনালেন তার অমর কবিতাখানি :
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
ব্যাখ্যাঃ বাঙালির শেকড় থেকে জেগে ওঠা এক বিদ্রোহী নেতা গণমানুষের অধিকার আদায়ের জন্যে মঞ্চ কাঁপিয়ে উদ্দীপ্ত ভাষায় শােনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি। সমবেত জনতার মাঝে তাঁর কবিতার বাণী ছড়িয়ে গেল। কৃষক, শ্রমিক, মজুর, নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবাই জেগে উঠল। সবাই দীক্ষিত হলাে মুক্তির মন্ত্রে । তাদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামী শক্তিকে শানিত করতে কবি বললেন- “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
» সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।
ব্যাখ্যাঃ তখন থেকেই স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের কাছে একটি অনন্য, অসাধারণ, মহৎ শব্দ হিসেবে পরিচিত। আমরা গভীর শ্রদ্ধায়, ভালােবাসায় এই শব্দটিকে আমাদের হৃদয়ে ধারণ করেছি।