সেই দিন এই মাঠ কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা   

সেই দিন এই মাঠ কবিতার মূলভাব

‘সেইদিন এই মাঠ’ কবিতায় কবি প্রকৃতির চিরকালীন সৌন্দর্যের এবং মানুষের স্বপ্নের অমরত্বের দিকটি তুলে ধরেছেন। কবিতায় সভ্যতারধ্বংস ও বিনির্মাণ উভয় দিক প্রতি হয়েছে। বিচিত্র বিবর্তনের মধ্যেও রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে প্রকৃতি টিকে থাকে। জাগতিক নিয়মে নশ্বর মানবজীবনস্রোত চলে অবিনশ্বর প্রকৃতির বিপরীতে টিকে থাকে কেবল মানবীয় কর্ম, চিন্তা আর স্বপ্ন। প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গে এগুলাে মিশে অমরত্ব দাবি করে। ফলে যুগ-যুগান্তর ধরে চলে আসা মানুষের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার গল্প প্রকৃতি চিরভাস্বর করে রাখে। প্রকৃতির চিরকালের ব্যস্ততা, মাঠের চঞ্চলতা, চালতাফুলে পড়ে থাকা শীতের শিশিরবিন্দু, লক্ষ্মীপেঁচার মঙ্গলধ্বনি প্রভৃতি কবির কাছে অমরত্বের প্রতীক। তাই পৃথিবীর বহমানতা মানুষের সাধারণ মৃত্যু ঠেকাতে না পারলেও স্বপ্ন বাঁচাতে পারে। মানুষের স্বপ্ন আর প্রকৃতি তাই এক হয়ে টিকে থাকে অনন্তকাল।

 

সেই দিন এই মাঠ কবিতার ব্যাখ্যা

» সেই দিন এই মাঠ স্তন্ধ হবে নাকো জানিএই নদী নক্ষত্রের তলে

সেদিননা দেখিবে স্বপ্ন

সােনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে।

ব্যাখ্যাঃ ‘সেইদিন এই মাঠ’ কবিতায় প্রকৃতির চিরকালীন সৌন্দর্যের মধ্যে সভ্যতার ধ্বংস ও বিনির্মাণের বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে। সভ্যতার বিচিত্র বিবর্তনের মধ্যেও আপন রূপ-রস গন্ধ নিয়ে প্রকৃতি টিকে থাকে। পৃথিবীতে প্রাণের যে প্রবাহ ও ঘটনার যে নিয়ত আবর্তন তা চিরন্তন। অসীম শূন্যতার নিচে প্রাণের উৎসব কখনাে থামবে না, শেষ হবে না ঘটনার পরম্পরাও সৃষ্টি আর ধ্বংসের খেলা পৃথিবীতে যেমন চলছে, তেমনি চলবে। পৃথিবীর বুকে সােনার স্বপ্নের মাঠ চিরন্তন, এর কোনাে শেষ নেই।

» আমি চলে যাব বলে

চালতাফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে

নরম গন্ধের ঢেউয়ে?

ব্যাখ্যাঃ কবি মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও প্রকৃতির নিয়মের কোনাে পরিবর্তন হবে না। তিনি থাকবেন না বলে চালতাফুলের শিশিরের জলে ভেজা বন্ধ হবে না। বন্ধ হবে না তার নরম গন্ধ ছড়ানাে। প্রকৃতির সবকিছুই আগের মতােই থাকবে। এই অনুভব কবিকে প্রাণিত করে।

» লক্ষ্মীপেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষ্মীটির তরে?

সােনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!

ব্যাখ্যাঃ কবি জানেন, পৃথিবীতে মানব কল্যাণের বাণী বা কল্যাণকর্ম কোনােকিছুই বিলীন হয় না। শুধু ব্যক্তি হারিয়ে যায়। কবি বা কোনাে করা হলাে। ফলে তােমরা সহজেই যেকোনাে প্রশ্নের উত্তর করতে পারবে। মানুষের মৃত্যুতেই পৃথিবীর গতিময়তা ও প্রকৃতির স্বাভাবিকতার কোনাে ব্যাঘাত ঘটে না। তিনি না থাকলে লক্ষ্মীপেঁচার মঙ্গলকর গান বন্ধ হবে না। পৃথিবীর সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই চলবে।

» চারিদিকে শান্ত বাতি- ভিজে গন্ধ মৃদু কলরব;

খেয়ানৌকোগুলাে এসে লেগেছে চরের খুব কাছে;

ব্যাখ্যাঃ পৃথিবীর এইসব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল;মানুষ মরণশীল। প্রকৃতির নিয়মের সঙ্গে তার মরণের সম্পর্ক নেই। প্রকৃতি তার নিয়মেই গতিশীল। কারও মৃত্যুতে তার কিছু এসে যায় না। সে জন্যই কোনাে মৃত্যুই প্রকৃতির স্বাভাবিকতায় কোনাে প্রভাব ফেলতে পারে না। তাই পৃথিবীর চারদিকে প্রকৃতি শান্ত থাকে, ভিজে ফুল গন্ধ ছড়ায়, পাখি সব কলরব করে। খেয়ানৌকা এসে ঘাটে লাগে নদীর তীরে চরের কাছাকাছি। পৃথিবীর এসব ঘটনা চিরন্তন। কখনাে তা হারায় না, বরং হারানাের সব গল্পকে ধরে রাখে।

» এশিরিয়া ধুলাে আজ- বেবিলন ছাই হয়ে আছে।

ব্যাখ্যাঃ পুরনাে সভ্যতা ধ্বংস হয়, নতুন সভ্যতা গড়ে ওঠে এশিরিয়া সভ্যতার বিলুপ্তি হয়েছে। নতুন আরেক সভ্যতা গড়ে উঠেছে। এক সময় রাজ্য, প্রশাসন, স্থাপত্য শিল্প, ভাস্কর্য আর কলাশিল্পে পৃথিবীর অদ্বিতীয় হিসেবে চিহ্নিত ছিল এশিরিয়া সভ্যতা। কিন্তু তা আজ আর নেই। বেবিলনীয় সভ্যতাও ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতি তার আপন রূপ-রসগন্ধ নিয়ে চিরকাল সতেজ ও প্রাণময় হয়ে আছে। পৃথিবীর বহমানতা মানুষের সাধারণ মৃত্যু রহিত করতে পারে না। জগতে মানুষের মৃত্যু আছে, কিন্তু মানুষের স্বপ্ন ও সৌন্দর্যের মৃত্যু নেই।

Leave a Comment