সাহসী জননী বাংলা কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা

সাহসী জননী বাংলা কবিতার মূলভাব

সাহসী জননী বাংলা কবিতায় কবি বাঙালির সংগ্রামী ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশকে ধ্বংসের শেষ পর্যায়ে দাঁড় করিয়েছিল পাকিস্তানি শত্রুবাহিনী। তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জয়লাভ করা বাঙালিকে কবি বাংলা জননীর সাহসী সন্তান রূপে আখ্যায়িত করেছেন। সাহসী জননী বাংলা কবিতায় কবি এদেশের মানুষের মনে কাব্যময় স্নিগ্ধতার সঙ্গে সাহসের ইস্পাতদৃঢ়তার দিকটি তুলে ধরেছেন। যা দ্বারা বাঙালি খুব সহজেই শত্রুর আসুরিক আচরণ, বিকট উল্লাস, নৃশংসতাকে স্বল্প সময়ের মধ্যেই প্রতিহত করতে পারে। বাঙালিকে যে ভীরু ও ভেতাে বলে খাটো করা হয় তা মােটেও যুক্তিসংগত নয়। কারণ বাঙালি অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহসী জাতি। বাঙালির সুদীর্ঘ সংগ্রামী ইতিহাস-ঐতিহ্য প্রতিফলিত হয়েছে আলােচ্য কবিতায়। এগুলাের মধ্য দিয়ে কবি বাঙালির সংগ্রামী চেতনাকে একদিকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন, অন্যদিকে সেই চেতনায় নতুন করে প্রদীপ্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।

সাহসী জননী বাংলা কবিতার ব্যাখ্যা

» তোদের অসুর নৃত্য… ঠা ঠা হাসি … ফিরিয়ে দিয়েছি

তোদের রক্তাক্ত হাত মুচড়ে দিয়েছি নয় মাসে

ব্যাখ্যাঃ পাকিস্তানি হানাদাররা এদেশের মধ্যে পৌরাণিক কাহিনির অসুরের মতাে তাণ্ডব চালিয়েছে, গুলি করে নির্বিচারে নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করেছে, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করেছে গ্রামের পর গ্রাম। বাঙালি জাতি তাদের সেই অত্যাচারের   সমুচিত জবাব দিয়েছে। তারা দীর্ঘ নয় মাস লড়াই করে বর্বরদের অসুর নৃত্য থামিয়ে দিয়েছে। তারা বন্দুকের গুলি দিয়েই শত্রুর গুলির প্রতিবাদ করেছে, তাদের অসুর নৃত্য, ঠা ঠা হাসি ফিরিয়ে দিয়েছে। কবি এখানে বাঙালিদের সাহস ও সংগ্রামী মনােভাবটি ব্যক্ত করেছেন।

» চির কবিতার দেশ 

ডেবেছিলি অস্ত্রে মাত হবে

ব্যাখ্যাঃ বাংলাদেশকে কবিতার দেশ বলা হয়েছে। এখানে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, অধিকার সচেতনতা ও প্রতিবাদী চেতনাকে নির্দেশ করা হয়েছে। পাকিস্তানি হানাদাররা চেয়েছিল নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে, তাদের ভারী ভারী অস্ত্রের মাধ্যমে বাঙালির প্রতিবাদী কণ্ঠকে থামিয়ে দেবে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।

» বাঙালি অনার্য জাতি, খর্বদেহ … ভাত খায়, ভীতু

কিন্তু কী ঘটল শেষে, কে দেখাল মহা প্রতিরােধ।

ব্যাখ্যাঃ ভারতবর্ষে অনেক আগে থেকেই বহু জাতি-ধর্মের লােক বসবাস করত। তারা অনার্য হিসেবে পরিচিত ছিল। তখন আর্যরা অনার্যদের ঘৃণার চোখে দেখত, তাদের ওপর নানাভাবে অত্যাচার চালাত। শারীরিকভাবে খর্বকায় বলেও তারা অবহেলার শিকার হতাে। দীর্ঘদেহী পাকিস্তানি বর্বর হানাদাররা ভেবেছিল খর্বকায় দেহের ভিতু বাঙালিরা সারা জীবন শাসন, শােষণ, অত্যাচার সহ্য করেই এসেছে; এখনও তাই করবে। তারা মনে করত প্রতিবাদ করার বা মুখােমুখি দাঁড়ানাের সাহস বা শক্তি কোনােটাই এদের নেই। বাঙালিরা তাদের সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে। তারা প্রতিবাদ করেছে। বুকে সাহস নিয়ে সমস্ত শক্তি নিয়ে হানাদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে মহাপ্রতিরােধ গড়ে তুলেছে।

» অ আ ক খ বর্ণমালা পথে পথে তেপান্তরে ঘুরে

উদ্বাস্তু আশ্রয়হীন .. পােড়াগ্রাম … মাতৃ অপমানে

কার রক্ত ছুঁয়ে শেষে হয়ে গেল ঘৃণার কার্তুজ।

ব্যাখ্যাঃ অ, আ, ক, খ, বর্ণমালা অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বাঙালির বিজয়ে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। বাঙালিরা রক্ত দিয়ে বুঝিয়েছে, কীভাবে দাবি আদায় করতে হয়। ভাষার জন্য আত্মত্যাগের প্রেরণার পথ ধরেই তারা মুক্তির পথে, স্বাধীনতার পথে এগিয়ে গেছে। বাঙালিরা শত্রুদের অসুর নৃত্যে আশ্রয়হীন উদ্বাস্তু হয়েছে। পােড়াগ্রামে প্রিয়জনদের হারিয়েছে, মা-বােনদের হত্যা-নির্যাতনের করুণ দৃশ্য দেখেছে। এসব দেখে দেখে তাদের বুকে ঘৃণা জমেছে। রক্তে প্রতিশােধের স্পৃহা জেগেছে। কবি বাঙালি জাতির বিস্ফোরণােন্মুখ ঘৃণার এ সম্মিলনকে ঘৃণার কার্তুজ মনে করেছেন।

» সাহসী জননী বাংলা, বুকে চাপা মৃতের আগুন

রাত জাগে পাহারায় … বুড়িগঙ্গা পদ্মা নদীতীর

ডাকাত পড়েছে গ্রামে, মধ্যরাতে হানাদার আসে।

ভাই বােন কে ঘুমায়? জাগে, নীলকমলেরা জাগে।

ব্যাখ্যাঃ বাংলা বাঙালির কাছে মায়ের মতাে, অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভালােবাসার বস্তু। পাকিস্তানি বর্বর হানাদাররা পদ্ম- বুড়িগঙ্গার তীরে এসে দস্যুর মতাে এদেশে যে হানা দিয়েছিল বাঙালিরা তার প্রতিবাদ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে রুখে পঁড়িয়েছে। বাঙালিরা রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। রূপকথার রাজপুত্র নীলকমল যেমন করে মহাশক্তিধর রাক্ষসের সঙ্গে প্রাণপণ যুদ্ধ করে রাজকন্যাকে উদ্ধার করেছিল, বাঙালিরা তেমনই যুদ্ধ করে প্রিয় জন্মভূমিকে শত্রুর শাসন-শােষণ থেকে রক্ষা করেছে। পাকিস্তানিরা এদেশে মধ্যরাতে ঘুমন্ত মানুষদের ওপর যে তাণ্ডব চালিয়েছিল, বাঙালি নয় মাস যুদ্ধ করে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে তার উপযুক্ত জবাব দিয়েছে।

» গ্রেনেড উঠেছে হাতে … কবিতার হাতে রাইফেল

এবার বাঘের থাবা, ভােজ হবে আজ প্রতিশােধে

যার সঙ্গে যে রকম, সে রকম খেলবে বাঙালি

খেলেছি, মেরেছি সুখে … কান কেটে দিয়েছি তােদের।

ব্যাখ্যাঃ মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির হাতে গ্রেনেড যেমন ছিল, তেমনই ছিল প্রতিবাদী কবিতার অনুপ্রেরণা। কবিতায় যে প্রকৃতির কথা, প্রেমের কথা, প্রতিবাদের কথা, প্রতিশােধের কথা থাকে, তা বাঙালিকে প্রকৃতির জন্য, প্রেমের জন্য, অনেক সাহসী ও প্রতিবাদী করে তুলেছিল। তাদেরকে প্রতিরােধের পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাইফেল হাতে মুক্তিযোেদ্ধারা যেমন যুদ্ধ করেছে, কবিতাও তেমনি তার প্রতিবাদী ভাষায় শত্রুকে ঘায়েল করেছে। বর্বর হানাদাররা যে নৃশংসতা এদেশের মানুষের প্রতি দেখিয়েছে, বাঙালিও তার সমুচিত জবাব দিয়েছে। তাদের পরাজয়ের পথ নিশ্চিত করেছে। তারা যেমন দানবের মতাে এদেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তেমনই পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে অবশেষে তারা এদেশ ছেড়ে পালিয়েছে। যােদ্ধা হিসেবে, বীর হিসেবে, শাসক হিসেবে তাদের যে অহংকার ছিল বাঙালিরা তা খুঁড়িয়ে দিয়েছে। বাঙালিদের কাছে তারা আত্মসমর্পণ করে। এতে তাদের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়েছে, তাদের কান কাটা গেছে।

» এসেছি আবার ফিরে … রাতজাগা নির্বাসন শেষে

এসেছি জননী বঙ্গে স্বাধীনতা উড়িয়ে উড়িয়ে…

ব্যাখ্যাঃ মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাংলা মায়ের সন্তানেরা আবার ঘরে ফিরে এসেছে। তাদের রাতজাগা নির্বাসনের অবসান হয়েছে। কারণ যুদ্ধের সময় তারা নিজ দেশে কিংবা প্রতিবেশী দেশে নির্বাসিত জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছে। এ অবস্থাতেই তারা গড়ে তােলে প্রতিরােধ। তারা শত্র হননের নেশায় মগ্ন থেকেছে, নিঘুম রাত কাটিয়েছে। তাদের সেই দিনগুলাের অবসান হয়েছে। পরাধীন থাকার, নির্বাসনে থাকার দিন তাদের শেষ হয়েছে। আজ তারা স্বাধীন। স্বাধীনতার সুখ নিয়ে, স্মৃতি নিয়ে, স্বপ্ন নিয়ে বিজয় কেতন উড়িয়ে তারা আজ বাংলা মায়ের কোলে ফিরে এসেছে।

Leave a Comment