রানার কবিতার মূলভাব
‘রানার’ কবিতায় কবি শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাপন, দুঃখবােধ এবং তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে সততার দিকটি তুলে ধরেছেন। কবিতায় যাদের ক্লান্ত শ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে, তাদের কথা বলা হয়েছে। রানার মানুষের সুখ-দুঃখের অনেক অজানা সংবাদবাহক। পিঠে খবরের বােঝা, মানি অর্ডার নিয়ে রাত্রির অন্ধকারে লণ্ঠন জ্বালিয়ে, ঝুমঝুম্ ঘন্টা বাজিয়ে ছুটে চলে রানার। সূর্য ওঠার আগেই সে গন্তব্যে পৌছতে চায়। তাই পথে দস্যুর ভয়ের চেয়ে সূর্য ওঠায় তার বড় ভয়। সুখে, দুঃখে, আনন্দে, শােকে, প্রেমে, আবেগে, স্মৃতিতে লােকে যেসব চিঠি লেখে সেগুলাে সে তাদের প্রিয়জনদের কাছে পৌছে দেয়। আর তার নিজের জীবনের কষ্টের কথা চাপা পড়ে থাকে। ক্ষুধিত রানারের জীবনের দুঃসহ যন্ত্রণা পথের তৃণের কাছে পড়ে থাকে। দুঃখের কথা শহরের কিংবা গ্রামের কেউ জানতে পারবে না, তা কালাে রাত্রির খামে ঢাকা পড়ে থাকবে। পিঠে টাকার বােঝা সে বহন করে কেবল, ছুঁয়ে দেখে না। এই সততার মূল্য তার পারিপার্শ্বিক সমাজ তাকে দেয় না। তাই তার জীবনের দুঃখের কাল অবসানের খবর কখন আসবে তা কেউ জানে না। তবুও কবি আশা করেন ভীরুতা পেছনে ফেলে শ্রমজীবীরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে একদিন অগ্রগতির ‘মেলে সে খবর বয়ে আনবে। সেদিন সাম্যের, মানবতার জয় হবে।
রানার কবিতার ব্যাখ্যা
» রানার ছুটেছে তাই ঝুমুঝুম্ ঘন্টা বাজছে, রাতে।
রানার চলেছে খবয়ের বােকা হাতে,
রানার চলেছে, ‘রানার।
রাত্রির পথে পথে চলে কোনাে নিষেধ জানে না মনির।
দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছােটে রানার-কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার।
ব্যাখ্যাঃ মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখের নানা সংবাদের বোঝা কাধে নিয়ে ডাকবাহক ছুটে চলছে। রাতের অন্ধকারে সে ছুটে চলে, কারও কোনাে নিষেধ মানে না। সে মানুষের জীবনের নতুন। নতুন সংবাদ বহনের কাজ নিয়েছে। তাকে দিগন্ত থেকে দিগন্তের পানে ছুটে বেড়াতে হয়। এ কারণেই সে রাতের বেলাতেও পথে পথে ছুটে চলে।
» রানার! রানার!
জানা-অজানার
বােঝা আজ তার কাঁধে,
বােঝাই জাহাজ রানার চলেছে চিঠি আর সংবাদে;
রানার চলেছে, বুঝি ভাের হয় হয়,
আরাে জোরে, আরাে জোরে, এ রানার দুর্বার দুর্জয়।
ব্যাখ্যাঃ ডাকবাহক জানা-অজানার বহু সংবাদ কাঁধে ছুটে চলে। তার পিঠে সংবাদের বােঝা দেখে বােঝাই জাহাজের মতাে মনে, হয়। রানার দুর্বার ছুটে চলে। তার মনে এই আশঙ্কা এই বুঝি রাত শেষ হয়ে ভাের হয়ে এলাে। সে আরও জোরে ছুটতে থাকে। তার চলার সেই গতি নির্ভয়, দুর্বার-দুর্জয়।
» তার জীবনের স্বপ্নের মতাে পিছে সরে যায় বন,
আরাে পথ, আরাে পথ-বুঝি হয় লাল ও পূর্ব কোণ।
অবাক রাতের তারারা, আকাশে মিটমিট করে চায়;
কেমন করে এ রানার সবেগে হরিণের মতাে যায়।
কত গ্রাম কত পথ যায় সরে সরে
শহরে রানার যাবেই পৌছে ভােরে;
হাতে লণ্ঠন করে ঠনঠন, জোনাকিরা দেয় আলাে
মাভৈঃ রানার! এখনাে রাতের কালাে।
ব্যাখ্যাঃ তার চলার দুর্বার গতিতে পথের ধারের বন পিছে সরে যায়। এ যেন রানারের জীবনের স্বপ্নের মতাে পিছে পড়ে থাকা। রানার ছুটে চলে, তার সামনে আরও অনেকটা পথ বাকি। অথচ পূর্ব কোণ লাল হয়ে এসেছে। আকাশের তারারা মিটমিট করে জ্বলছে। রানার হরিণের মতাে সবেগে ছুটে হলাে। ফলে তােমরা সহজেই যেকোনাে প্রশ্নের উত্তর করতে চলছে গন্তব্যের দিকে। তার চলার পথের পাশে গ্রামগুলাে সরে সরে যায়, সেদিকে তার খেয়াল নেই। তার লক্ষ্য ভােরের মধ্যেই তাকে শহরে পৌছতে হবে। তার হাতের হারিকেন ঠনঠন করে বাজে, তেল ফুরিয়ে আসে, জোনাকিরা ম্লান আলাে জ্বেলে দেয়, তখনও রাতের কালাে শেষ হয়নি। এমন পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে রানার ছুটে চলে।
» এমনি করেই জীবনের বহু বছরকে পিছু ফেলে,
পৃথিবীর বােঝা ক্ষুধিত রানার পৌছে দিয়েছে ‘মেলে’।
ক্লান্তঘাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে
জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে।
অনেক দুঃখে, বহু বেদনায়, অভিমানে, অনুরাগে,
ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিদ্রি রাত জাগে।
ব্যাখ্যাঃ রানার নতুন সংবাদের বােঝা কাঁধে নিয়ে গ্রামের মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর পেছনে ফেলে শহরের পানে ছুটে চলে। ঠিক একইভাবে জীবনের বহু বছর, বহু চাওয়া-পাওয়া, আশা-স্বপ্ন পেছনে ফেলে ক্ষুধিত রানার মানুষের কাছে সংবাদ পৌছে দিয়ে নিজে পৃথিবীর বােঝা হয়ে থেকেছে। তার ক্লান্ত নিশ্বাস আকাশ ছুঁয়েছে। তার শরীরের ঘামে মাটি ভিজেছে। জীবনের সব আশা-স্বপ্ন নে সামান্য মূল্যে বিক্রি করেছে। রানার ছুটে চলে পথে পথে । আর প্রিয়া একা বহু বেদনায়, অভিমানে, অনুরাগে তার অপেক্ষায় নিঘুম রাত পার করে।
» রানার! রানার!
এ বােঝা টানার দিন কবে শেষ হবে?
রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে?
রানার জানে না তার এ বােঝা টানার দিন কবে শেষ ব্যাখ্যাঃ হবে। রাতের
আঁধার কেটে কখন তার জীবনের সূর্য উঠবে সেটাও তার অজানা।
» ঘরেতে অভাব; পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালাে ধোঁয়া,
পিঠেতে টাকার বােঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া,
রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছােটে,
দস্যুর ভয়, তারাে চেয়ে ভয় কখন সূর্য ওঠে।
ব্যাখ্যাঃ ক্লান্ত-বিষন্ন রানারের ঘরে অভাব। দারিদ্র্যের কশাঘাতে পৃথিবীটা তার কাছে কালাে ধোঁয়ার মতাে মনে হয়। সে প্রতিনিয়ত টাকার বােঝ। পিঠে বহন করে নিয়ে যায়। অথচ সেই টাকা সে ছুঁতে পারে না। নির্জন রাতে সে সেই বােঝা নিয়ে ছুটে চলে। পথে নানা রকম ভয় তাকে তাড়া করে। তবুও সে থামে না, ছুটে চলে। পথে ডাকাতের আক্রমণ, জীবন-বিপন্নের ভয়ের চেয়েও তার বড় ভয় সূর্য ওঠার ভয়। কারণ সূর্য ওঠার আগেই তাকে শহরে পৌঁছে যেতে হবে।
» কত চিঠি লেখে লােকেকত সুখে, প্রেমে, আবেগে, স্মৃতিতে, কত দুঃখে ও শশাকে।
এর দুঃখের চিঠি পড়বে না জানি কেউ কোনাে দিনও,
এর জীবনের দুঃখ কেবল জানবে পথের তৃণ,
এর দুঃখের কথা জানবে না কেউ শহরে ও গ্রামে,
এর কথা ঢাকা পড়ে থাকবেই কালাে রাত্রির খামে।
ব্যাখ্যাঃ মানুষ কত রকম চিঠি লেখে। সুখ-দুঃখ, প্রেম, আবেগঅনুভূতির নানা কথা থাকে সেসব চিঠিতে। শশাকের সংবাদও থাকে। কেবল রানারের জীবনের কোনাে চিঠি থাকে না। কবি জানেন রানারের নিজের জীবনের দুঃখের চিঠি কেউ কোনাে দিন লিখবেও না, পড়বেও না। তার কথা কেউ মনেও রাখবে। তার জীবনের দুঃখ-বেদনার কথা কেবল পথের তৃণের কাছে পড়ে থাকবে। তাছাড়া শহর ও গ্রামের কেউ জানবে না। তার কথা কালাে রাতের আঁধারের খামে পড়ে থাকবে।
» দরদে তারার চোখ কাপে মিটিমিটি,
এ-কে যে ভােরের আকাশ পাঠাবে সহানুভূতির চিঠি
রানার! রানার! কী হবে এ বােঝা বয়ে?
কী হবে ক্ষুধার ক্লান্তিতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে?
রানার! রানার! তাের তাে হয়েছে- আকাশ হয়েছে লাল।
আলাের স্পর্শে কবে কেটে যাবে এই দুঃখের কাল?
ব্যাখ্যাঃ রানারের ক্লান্ত, বিষন্ন, দুঃখময় জীবনের প্রতি প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ ব্যথিত। তার দরদে যেন তারার চোখ মিটি মিটি করে কাঁপে। তাকে ভােরের আকাশের আলাে সহানুভূতির সংবাদ পাঠাবে। তারা সুধাবে, কী হবে এ বােঝা বয়ে? কী হবে ক্ষুধার ক্লান্তিতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে? তারা রানারকে ডেকে বলে- হে রানার, ঐ দেখ, ভাের হয়েছে, আকাশে লাল হয়ে সূর্য উঠেছে। এই আলাের স্পর্শে কবে তােমার দুঃখের কলি অবসান হবে?
» রানার। গ্রামের রানার।
সময় হয়েছে নতুন খবর আনার;
শপথের চিঠি নিয়ে চলাে আজ
ভীরুতা পিছনে ফেলে
পৌছে দাও এ নতুন খবর,
অগ্রগতির ‘মেলে,
ব্যাখ্যাঃ রানার গ্রামের মানুষ। দুঃখ-দারিদ্র্য তার নিত্যসঙ্গী। তবু সে নতুন খবর আনার জন্য ছুটে চলে। আজ আর সূর্য ওঠার ভয় নয়, শহরে খবর পৌছে দেওয়া নয়। অগ্রগতির মেলে আজ জীবনের খবর পৌছে দেওয়ার পালা। তাই সমস্ত ভীরুতা পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সংবাদ আছে এমন শপথের চিঠি রানারকে পৌছে দিতে হবে। যারা অল্প দামে তার জীবনের মূল্যবান রাতগুলাে কিনে নিয়েছে তাদের মুখােমুখি দাড়ানাের, প্রতিকারের চেতনাসমৃদ্ধ সে চিঠি রানার বহন করে আনবে।
» দেখা দেবে বুঝি প্রভাত এখুনিনেই, দেরি নেই আর,
ছুটে চলল, ছুটে চলল, আরাে বেগে
দুর্দম, হে রানারা
ব্যাখ্যাঃ কাজেই সেই সময় আর দূরে নয়। অপেক্ষার কাল অবসান হয়েছে। আরও বেগে ছুটে চলে রানার সেই সময়কে সামনে নিয়ে আসবে। তাই দুর্দম তার পথচলা।