মানবধর্ম কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা

মানবধর্ম কবিতার মূলভাব

সব লােকে কয় লালন কী জাত সংসারে গানটি ‘মানবধর্ম’ কবিতা হিসেবে পাঠ্য বইয়ে সংকলিত হয়েছে। এ কবিতায় লালন ফকির মানুষের জাত পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। নিজে কোন ধর্মের বা জাতের, এমন প্রশ্ন লালন সম্পর্কে আগেও ছিল এখনও আছে। 

লালন বলেছেন, জাতকে তিনি গুরুত্বপুর্ণ মনে করেন না। মনুষ্যধর্মই মূলকথা। জন্মমৃত্যু কালে কি কোনাে মানুষ তসবিহ বা জপমালা ধারন করে থাকে ? সে সময় সবাই সমান থাকে। কখনই চেনা যায় না সে কোন জাতের বা ধর্মের । মানুষ জাত ও ধর্ম ভেদে যে ভিন্নতার কথা বলে লালন তা বিশ্বাস করেন না । লালনের মতে , মানবধর্ম তথা মনুষ্যত্ববােধই মানুষের প্রকৃত পরিচয় । তাই জাতপাত নিয়ে বাড়াবাড়ি করা উচিত নয় ।

 

মানবধর্ম কবিতার ব্যাখ্যা

সব লােকে কয় লালন কী জাত সংসারে। 

ব্যাখ্যা: মানুষ লালনকে তাঁর জাত-পাত সম্পর্কে প্রশ্ন করে জানতে চায়। তারা জানতে চায় তিনি কোন্ ধর্মের লােক বা তাঁর পরিচয়ই বা কী ? এটা মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা সে অন্যের জাত , ধর্ম ইত্যাদি পরিচয় জানতে চায়।

 

লালন কয়, জেতের কী রূপ, দেখলাম না এ নজরে । 

ব্যাখ্যা: মানুষের জিজ্ঞাসার উত্তরে লালন বলেন , তিনি তাঁর নজর বা দৃষ্টি শক্তি দিয়ে বিচার করে জেতের তথা জাতের পরিচয় জানতে সক্ষম হননি। তিনি এ কথা দ্বারা বুঝাতে চেয়েছেন তাঁর কাছে সব মানুষ একই মনে হয়েছে। জাত কীভাবে মানুষকে আলাদা করে তা তিনি বুঝতে পারেননি।

 

কেউ মালা , কেউ তসবি গলায় , 

তাইতে কী জাত ভিন্ন বেলায়।

ব্যাখ্যা: কবি লালন শাহ এখানে বলতে চেয়েছেন, আমরা কিছু বাইরের বৈশিষ্ট্য বা চিহ্ন দিয়ে জাত বিচার করি। যেমন: হিন্দু ঋষি, সন্ন্যাসিরা গলায় বুদ্রাক্ষের মালা পরেন, আবার মুসলমান মৌলবি বা মাওলানার গলায় থাকে তসবি। এসবই বাইরের দিক। এসব দিয়ে জাতবিচার অনেক সময় সঠিক হয় না। 

 

যাওয়া কিংবা আসার বেলায়

জেতের চিহ্ন রয় কার রে।

ব্যাখ্যা: সব জাত ও ধর্মের মানুষই জন্মের সময় একইভাবে পৃথিবীতে আসে। সদ্যোজাত মানবসন্তানের গায়ে আলাদা কোনাে জাতের চিহ্ন থাকে না। তেমনি মৃত্যুর পর মানবদেহ যখন ধুলায় পরিণত হয়, তখন তাও কোনাে জাতের চিহ্ন বহন করে না।একটা নতুন জন্ম নেওয়া শিশু এবং মৃত কঙ্কাল দেখে তার জাত পরিচয় শনাক্ত করা যায় না।

 

গর্তে গেলে কুপজল কয় ,

গঙ্গায় গেলে গঙ্গাজল হয়।

ব্যাখ্যা: একই জল যখন গর্তের মধ্যে থাকে তখন তাকে আমরা কুয়ার জল বলি। আবার সেই জল গঙ্গায় প্রবাহিত হলে তাকে গঙ্গাজল বলি। হিন্দুদের কাছে গঙ্গা নদীর পানি পবিত্রতার প্রতীক।

 

মুলে এক জল, সে যে ভিন্ন নয়,

ভিন্ন জানায় পাত্র অনুসারে।

ব্যাখ্যা: কবি বুঝাতে চেয়েছেন সব জলই এক। ভিন্ন পাত্রে রাখলে তার ভিন্ন পরিচয় হয়। সাধারন গর্ত বা কুয়ার মধ্যে থাকলে তার এক রকম পরিচয়, আবার সেইমএকই জল যদি গঙ্গার মতাে পবিত্র নদীতে থাকে তবে তার আরেক ধরনের পরিচয়। তেমনি মানুষও সব একই রকমের। এক এক জাতে জন্ম নিয়ে ভিন্ন পরিচয় পায়।

 

জগৎ বেড়ে জেতের কথা,

লােকে গৌরব করে যথা-তথা।

ব্যাখ্যা: পৃথিবীতে মানুষের কাছে তার জাতের পরিচয়টাই বড়। তারা জাত পাত বা বংশ নিয়ে এখানে সেখানে গৌরব করে বেড়ায়। অথচ তা ঠিক নয়। কারণ জাত-পাতই মানুষের মূল পরিচয় নয়।

 

লালন সে জেতের ফাতা

বিকিয়েছে সাত বাজারে।

ব্যাখ্যা: লালন জাতের পরিচয়ে বিশ্বাস করেন না। তিনি জেতের ফাতা অর্থাৎ জাতের নিশান বা চিহ্ন অনেক আগেই সাত বাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন। এখানে সাত বাজারে বিক্রি করে দেওয়াকে রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। কোনাে কিছু বিক্রি করে দিলে নিজের কাছে আর তার অস্তিত্ব থাকে না।

Leave a Comment