বঙ্গবাণী কবিতা বিশ্লেষণ
বক্তব্যবিষয়ঃ
মধ্যযুগের বাংলা কাব্যসাহিত্যের অন্যতম কবি আবদুল হাকিম মধ্যযুগের কবিদের মধ্যে তিনিই বাংলা ভাষার প্রথম কবি যিনি দেশি ভাষার গুণকীর্তন করে কাব্য রচনা করেছেন। তার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করে পরবর্তীকালের কবি-সাহিত্যির সাহিত্য রচনা করেছেন। ‘বঙ্গবাণী’ কবিতায় কবি মাতৃভাষা বাংলার প্রতি সুগভীর ভালােবাসা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন সেকালে একশ্রেণির মানুষ সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষায় রচিত গ্রন্থসমূহ বিশেষ করে ধর্মীয় বিষয়কে বাংলা ভাষায় রূপান্তরের ঘাের বিরােধী ছিলেন। অথচ তাদের বােধগম্য ভাষা হচ্ছে নিজ নিজ মাতৃভাষা। কবি উপলব্ধি করেছেন, বাংলা ভাষায় গ্রন্থ রচিত না হলে সাধারণ মানুষ তার অধিকার থেকে বঞিত হবে। মানুষের নিজ ধর্ম পালনের মাধ্যমে আল্লাহর কৃপা পাওয়ার সমান অধিকার রয়েছে। আর মহান স্রষ্টা তার সৃষ্ট সব পশু-পাখি ও মানুষের ভাষাই বুঝতে পারেন। তাই কবি নিজ ভাষায় কাব্য রচনার এবং ধর্মীয় উপাসনার পক্ষে তার মতামত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, মারফত সম্পর্কে যারা অজ্ঞ তারাই হিন্দুয়ানি ভাষাজ্ঞানে বাংলা ভাষার প্রতি অনীহা প্রকাশ করে। বাংলার মাটিতে জন্মে যারা বাংলা ভাষার প্রতি বিরূপ মনােভাব পােষণ করে কবি তাদের জন্মপরিচয় নিয়ে সন্দিহান। কবির মতে, তাদের এ দেশ ত্যাগ করা উচিত। সব ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই দেশীয় ভাষার সহজবােধ্যতা সাধারণ মানুষের বােধগম্য। ফলে জ্ঞানান্বেষণে সুবিধার কথা চিন্তা করেই কবি আলােচ্য কবিতায় বাংলা ভাষায় গ্রন্থ রচনার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন।
বঙ্গবাণী কবিতা বিশ্লেষণঃ
» কিতাব পড়িতে যার নাহিক অভ্যাস।
সে সবে কহিল মােতে মনে হাবিলাষ।
তে কাজে নিবেদি বাংলা করিয়া রচন।
নিজ পরিশ্রম ততােষি আমি সর্বজন ।
ব্যাখাঃ সাধারণত বই-পুস্তক পড়া যাদের অভ্যাস নয়, এমন লােকেরা কবিকে তাদের মনের প্রবল ইচ্ছার কথা জানালেন। তাদের কথা শুনে কবি বুঝতে পারলেন, কেন তারা পড়তে পারেন না। যে ভাষায় বই-পুস্তক লেখা হয়, তা সাধারণের বােধগম্য ভাষা নয়, সেই ভাষায় তারা একে অন্যের সঙ্গে ভাব বিনিময় করেন না। তারা স্বাভাবিকভাবেই মাতৃভাষায় কথা বলে থাকেন। কাজেই মাতৃভাষাতেই বই-পুস্তক রচনা করা উচিত; তা হলে তারা তা পড়তে পারবেন। এ কারণে তাদের কথা বিবেচনা করে, তাদের আত্মতুষ্টি এবং পড়ার অভ্যাস গড়ে তােলার মানসে কবি মাতৃভাষায় গ্রন্থ রচনায় মনােনিবেশ করেন।
» আরবি ফারসি শাস্ত্রে নাই কোন রাগ।
দেশী ভাষে বুঝিতে ললাটে পুরে ভাগ ॥
আরবি ফারসি হিন্দে নাই দুই মত।
যদি বা লিখয়ে আল্লা নবীর ছিফত ॥
ব্যাখাঃ অন্য কোনাে ভাষার প্রতি কবির কোনাে রাগ নেই। আরবিফারসি ভাষার প্রতিও তিনি বিদ্বেষী নন। কারণ তিনি জানেন এসব ভাষায় আল্লাহ্ ও মহানবির নানান প্রশংসা, স্তুতি বর্ণিত হয়েছে। এসব ভাষার প্রতি সাধারণ মানুষও শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু ঐসব ভাষায় জ্ঞানচর্চা করা সাধারণের পক্ষে যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে যদি দেশি ভাষায় অর্থাৎ তাদের নিজের মাতৃভাষায় শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে তাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে। তাদের মনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে। এতে করে তারা প্রকৃত সত্যকে সহজে অনুধাবন ও গ্রহণ করতে পারবে। তাতে আরবি, ফারসি, হিন্দি প্রভৃতি ভাষার প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবােধ আরও বেড়ে যাবে। মাতৃভাষার জ্ঞান দিয়ে তারা অন্য ভাষা বুঝতে পারবে।
» যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ।
সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জনা ।।
সর্ববাক্য বুঝে প্রভু কিবা হিন্দুয়ানী।
বঙ্গদেশী বাক্য কিবা যত ইতি বাণী ।।
পৃথিবীর যেকোনাে দেশের যেকোনাে জাতি-গােষ্ঠীর মানুষ যে ভাষাতেই কথা বলুক না কেন, স্রষ্টা সেসব ভাষা বুঝতে পারেন । তিনি যে বিশেষ একটি ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা বুঝতে পারেন না, এমনটা নয়। কবির মতে মানুষ মাত্রেই নিজ ভাষায় স্রষ্টাকে ডাকে। আর স্রষ্টাও সহজেই মানুষের বক্তব্য, তাদের মনের ইচ্ছা ও ব্যাকুলতা বুঝতে পারেন। কারণ কোনাে ভাষার বাণীই তাঁর অজানা নয়। তিনি দেখেন যে, তাঁর সৃষ্টি তাঁকে স্মরণ করে কিনা। তার কাছে ভাষাটা মুখ্য নয়, এই স্মরণ করাটাই মুখ্য।
» মারফত ভেদে যার নাহিক গমন।
হিন্দুর অক্ষরে হিংসে সে সবের গণ ॥
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি ॥
যারা সাধনা করেনি তারা স্রষ্টাকে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে পারেনি। স্রষ্টাকে সম্যকভাবে জানার জন্য মরমি সাধনার প্রয়ােজন, যারা তা করেনি, তারাই আরবি-ফারসি ভিন্ন অন্য ভাষাকে হিংসা করে। তাদের জ্ঞানের দীনতা প্রবল। এক্ষেত্রে কবির চিত্তে তীব্র ক্ষোভ জমে। মারফতে জ্ঞানহীন সেসব ক্ষীণচিন্তার মানুষকে তিনি ভৎসনা করেন। এই বাংলা ভাষাবিদ্বেষীদের বংশ ও জন্ম পরিচয় সম্পর্কে কবি সন্দেহ পােষণ করেন। বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে, অথচ বাংলা ভাষার প্রতি মমতা নেই, শ্রদ্ধা নেই, তাদের এদেশে থাকার কোনাে অধিকার নেই।
» দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায় ॥
মাতা পিতামহ ক্ৰমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি ॥
কবি জানতে চান- স্বদেশ ও স্বভাষার প্রতি যাদের কোনাে অনুরাগ নেই তারা কেন এদেশ পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায় না। কবি যুক্তি দেখিয়ে বলেন যে বংশানুক্রমে বহুকাল ধরে এদেশেই তার বসতি, এদেশ তার প্রিয় মাতৃভূমি। এদেশের মানুষের মুখের ভাষা বাংলা। মাতৃভাষায় বলা কথা তার মর্ম স্পর্শ করে। এ ভাষাতেই এদেশের মানুষের অনুরাগ-অনুভূতির পূর্ণ প্রকাশ ঘটে। এ ভাষার চেয়ে হিতকর আর কোনাে ভাষা নেই। তিনি বলেন বাংলা ভাষায় যত উপদেশ বাণী রচিত হবে, তা আমাদের পুনঃপুন মনকে জাগিয়ে তুলবে। আত্মবিশ্বাসী কবি এ কবিতায় সেটিই প্রত্যাশা করেছেন।