তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা কবিতার মূলভাব
‘তােমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে সর্বস্তরের বাঙালি নারী-পুরুষের সংগ্রামী চেতনা এবং তাদের মহান আত্মত্যাগের মহিমাকে তুলে ধরা হয়েছে। এ কবিতায় বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। তারা এদেশের নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাপিয়ে পড়ে গণহত্যা চালায়। ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ এদেশের সাধারণ মানুষকে তারা নির্বিচারে হত্যা করে, আগুন দিয়ে মানুষের ঘরবাড়ি-বন্তি পুড়িয়ে দেয়। তাদের নির্মমতায় সাকিনা বিবির মতাে নারীদের সহায়-সম্বল-সন্ড্রম সবকিছু বিসর্জিত হয়। হরিদাসীর মতাে নারীরা স্বামী হারান। শিশুরা মা-বাবাকে হারায়। এদেশের নিরীহ মানুষ সগীর আলী, কেষ্ট দাস, মতলব মিয়া, রুস্তম শেখও তাদের নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। কবি এদের নাম ও পেশার কথা কবিতায় উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। কবি স্বাধীনতার কাছে জানতে চেয়েছেন- এত রক্ত, এত ত্যাগের পরও কি সে আসবে? তার আসতে হলে কি আরও রক্ত লাগবে? লাশ লাগবে? আগুনে পােড়া ঘরের খুঁটি ধরে মােল্লাবাড়ির বিধবার প্রতীক্ষার প্রহর কি শেষ হবে না? অনাথ কিশােরীর শূন্য থালায় ক্ষুধার অন্ন সংস্থানের উপায় হিসেবে কি সে আসবে না? তাকে অবশ্যই আসতে হবে। আত্মবিশ্বাসী কবি তাই চারদিকে দামামা বাজিয়ে, নিশান উড়িয়ে স্বাধীনতার আগমনের নিশ্চয়তার বাণী শােনান স্বাধীনতাকামী এদেশের সব মানুষকে।
- তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা কবিতার বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও উত্তর
- তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর
- তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা
তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা কবিতার ব্যাখ্যা
»তােমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা
তােমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগশায়?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?
ব্যাখ্যাঃ এক অনন্য অনুভবে ঋদ্ধ অধিকারের নাম স্বাধীনতা, যা সহজলভ্য ও সহজপ্রাপ্য নয়। এর জন্য অনেক রক্ত দিতে হয়, অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। এদেশ স্বাধীনতার জন্য অনেকবার খাণ্ডবদাহন (মহাভারতে বর্ণিত ‘খাণ্ডব’ বন, যা ভীষণ অগ্নিকাণ্ডে পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছিল) ও রক্তগঙ্গা দেখেছে। বারবার দানবেরা আমাদের স্বাধীনতাকে হরণ করতে চেয়েছে। এদেশ বারবার রক্তস্রোতে ভেসেছে, এবার স্বাধীনতা অর্জন করে তবেই ক্ষান্ত হবে এ দেশের মানুষ।
»তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙল,
সিথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর।
ব্যাখ্যাঃ তারা অপরিমিত ত্যাগ-তিতিক্ষার পথ বেছে নিয়েছে স্বাধীনতা লাভ করতে। এ জন্য এ দেশের নারীরাও সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। সাকিনা আর হরিদাসীর স্বামী দেশকে স্বাধীন করতে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে তারা মৃত্যুবরণ করেছেন। ফলে সহায়-সম্বল, সম্ভম হারিয়ে কপাল ভেঙেছে , সাকিনা বিবির আর স্বামী হারিয়ে সিথির সিঁদুর মুছে গেছে হরিদাসীর।
»তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক এলাে
দানবের মতাে চিষ্কার করতে করতে
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হলাে।
ব্যাখ্যাঃ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক দানবের মতাে চিল্কার করতে করতে শহরে ঢুকে পড়ে। তারা কামানের গােলা আর অগ্নিকাণ্ডে শহরকে ধ্বংসভূপে পরিণত করে। নির্বিচার হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে উজাড় হয় বস্তি, ছাত্রাবাস। বাঙালিরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবে বলেই হানাদাররা এ ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
» রিকয়েললেস রাইফেল
আর.মেশিনগান খই ফোটাল যত্রতত্র।
তুমি আসবে বলে ছাই হলাে গ্রামের পর গ্রাম।
ব্যাখ্যাঃ শহরে গণহত্যা, ধ্বংসের পাশাপাশি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। তারা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল আর মেশিনগানের অবিরাম গুলিবর্ষণ করে যেখানে সেখানে। অসংখ্য মানুষকে হত্যা আর বাড়িঘর লুটপাটের পর পুড়িয়ে ছাই করে দেয় গ্রামের পর গ্রাম।
» তুমি আসবে বলে বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভুর বাস্তুভিটার
ভগভূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করল একটা কুকুর।
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতা-মাতার লাশের উপর।
ব্যাখ্যাঃ স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর ভয়ংকর ও বীভৎস আক্রমণ চালায়। তারা এদেশে গণহত্যা চালিয়ে মানুষের বাস্তুভিটা ভগ্ন্যুপে পরিণত করে। প্রভুর বিধ্বস্ত ভিটায় দাড়িয়ে একটা কুকুর কেবল একটানা আর্তনাদ করে। হানাদারদের নিষ্ঠুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া অবুঝ শিশুর পিতা-মাতার লাশের ওপর হামাগুড়ি দেওয়ার দৃশ্য ভীষণ বেদনাদায়ক।
» স্বাধীনতা, তােমার জন্যে থুথুড়ে এক বুড়াে
উদাস দাওয়ায় বসে আছেন। তাঁর চোখের নিচে অপরাত্নের
দুর্বল আলাের ঝিলিক, বাতাসে নড়ছে চুল।
ব্যাখ্যাঃ স্বদেশের স্বাধীনতার আনন্দ অনুভব করার জন্য অপেক্ষা করে আছেন চলার শক্তিহীন, বয়সের ভারে ন্যুজ এক থুথুড়ে বুড়াে। সবকিছু হারিয়ে উদাস হয়ে বসে আছেন তিনি। তার চোখের নিচে বিকালের দুর্বল আলাের ঝিলিক, বাতাসে নড়ছে মাথার অবশিষ্ট চুল।
» স্বাধীনতা, তােমার জন্যে
মােল্লাবাড়ির এক বিধবা দাঁড়িয়ে আছে
নড়বড়ে খুঁটি ধরে দগ্ধ ঘরের।
ব্যাখ্যাঃ স্বাধীনতার জন্য মােগ্লাবাড়ির এক বিধবা দাঁড়িয়ে আছে। তার মতাে অগণিত নারী নিঃস্ব হয়ে গেছে। তারা স্বামী-সন্তান, ভাই-বােন, বাবা-মা, আশ্রয় সবকিছু হারিয়েছে। আছে শুধু পােড়া ঘরের আধপােড়া খুঁটি। নড়বড়ে খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে সে নিজের অসহায় অবস্থা ঘােষণা করছে।
» স্বাধীনতা, তােমার জন্যে
হাড্ডিসার এক অনাথ কিশােরী শূন্য থালা হাতে
বসে আছে পথের ধারে।
ব্যাখ্যাঃ স্বাধীনতার জন্য কত বাবা-মা হারিয়েছেন তাদের প্রিয় সন্তান, একইভাবে কত সন্তান হারিয়েছে তাদের বাবা-মাকে। অসহায় এসব শিশু দারিদ্র্যের কশাঘাতে হাড্ডিসার। তারা পথের ধারে শূন্য থালা হাতে অপেক্ষায় বসে আছে। তাদের অধিকার কখন তারা ফিরে পাবে।
»তােমার জন্যে
সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,
কেষ্ট দাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লােকটা,
মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,
গাজী গাজী বলে যে নৌকা চালায় উদ্দাম ঝড়ে,
রুস্তম শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস
এখন পােকার দখলে
ব্যাখ্যাঃ পাকিস্তানি যুদ্ধবাজ সেনাদের গুলিতে ও বেয়নেটের আঘাতে অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছে। শাহবাজপুরের জোয়ান কৃষক সগীর আলী, জেলেপাড়ার দুর্দান্ত সাহসী লােক কেন্ট দাস- এদেরকে হানাদাররা হত্যা করেছে। মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি মতলব মিয়া জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের পারাপার করেছেন, নিজের জীবন দিয়ে তাদেরকে বাঁচিয়েছেন। | তাকে হত্যা করেছে দানবরা। ঢাকার রিকশাওয়ালা রুস্তম শেখকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে হানাদাররা। তার ফুসফুস এখন পােকার দখলে। স্বাধীনতা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় তারা জীবন উৎসর্গ করেছেন।
» আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুরে-বেড়ানাে
সেই তেজি তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তােমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।
ব্যাখ্যাঃ সব বয়সের তারুণ্যদীপ্ত স্বাধীনতাকামী মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। তেজি তরুণ মুক্তিযােদ্ধাদের মরণপণ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা পর্যদস্ত হয়েছে। তারা মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের শিকার হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এভাবেই হানাদারদের শক্তি নিঃশেষ হতে থাকে ক্রমশ । আর স্বাধীন বাংলাদেশের আসন্ন জন্মের প্রতীক্ষা করতে থাকে এ দেশের মানুষ।
» পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত
ঘােষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,
নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তােমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।
ব্যাখ্যাঃ এদেশের মানুষের কাঙ্ক্ষিত সেই স্বাধীনতা আসতে তখন আর দেরি নেই। এ দেশের মানুষ বুঝে গেছে স্বাধীনতা তাদের দরজায় করাঘাত করছে। কেননা তাদের আকাক্ষা, তাদের প্রত্যাশা, তাদের শ্রম ও ত্যাগ বৃথা যেতে পারে না। এদেশের মানুষের এত রক্ত, আত্মত্যাগ বৃথা যেতে পারে না। বিজয়ের জ্বলন্ত ঘােষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক এই বাংলায় স্বাধীনতা আসবেই। নবীন রক্তের প্রাণস্পন্দন আর আত্মত্যাগের মহিমায় বাঙালিরা স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনবেই- এটা কবিৱও প্রত্যাশা।