ঝর্ণার গান কবিতার মূলভাব
‘ঝর্ণার গান’ কবিতায় কবি ঝরনার গতিময়তা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকটি তুলে ধরেছেন। কবিতায় ঝরনার ছন্দময় শব্দে চঞ্চল ছুটে চলা মানবজীবনের গতিময়তা সৃষ্টির ইঙ্গিত বহন করে। ঝরনার রূপসৌন্দর্যে মানুষ পুলকিত হয়, মানসিক প্রশান্তি লাভ করে। ঝরনা ফুটে চলার পথে আপন ছন্দে বয়ে চলে সমস্ত নীরবতা ভেঙে। পাখির ডাকহীন নির্জন দুপুর, ভয়ংকর পাহাড়- সবকিছু উপেক্ষা করে ঝরনা পাথরের বুকে আনন্দের পদচিহ্ন রেখে বয়ে চলে। চমত্তার তার ধ্বনিমাধুর্য, বর্ণবৈচিত্র্য। ঝরনার সেই রূপসৌন্দর্য অতুলনীয়। গিরি থেকে পতিত এ জলরাশি পাথরের বুকে আঘাত করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মনােহর এ সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। কবি ঝরনার জলধারার সৌন্দর্য অবলােকনে আমাদের মানসিক শান্তি ও কর্মস্পৃহা শানিত করার প্রয়াস।
ঝর্ণার গান কবিতার ব্যাখা
» চপল পায় কেবল খাই,
কেবল গাই বীর গান,
পুলক মাের সকল গায়,
বিভােল পাের সফল প্রাণ।
ব্যাখাঃ ঝরনার মনের আনন্দে পাহাড় থেকে নিচে নেমে আসে। তার বুকে খুশির জোয়ার। সে পরির গান গায় । স্বৰ্গারণ্যে আনন্দ গানে পরিদের মৈতে ওঠার আনন্দ তার মনে। অসম্ভব খুশিতে ঝরনা আত্মভােলা হয়ে ইচ্ছেমতাে ছুটে বেড়ায় ।
» শিথিল সব শিলার পর
চরণ খুই দোদুল মন,
দুপুর-ভাের ঝিঝির ডাক,
ঝিমায় পথ, ঘুমায় বন।
ব্যাখ্যাঃ পাহাড় থেকে পড়ার সময় সে পাথরের উপর পা রাখে। তারপর আপন ছন্দে বয়ে চলে। পাথরের ফাকে ফাকে গড়িয়ে চলে দুরের নদীর দিকে যাওয়ার সময় সে পাথরের বুকে আনন্দের চিহ্ন রেখে যায়। ঝরনার আশপাশে কোনাে জনবসতি নেই। সব সময় সেখানে ঝিঝির ডাক শােনা যায় । পথ-ঘাট সব শান্ত থাকে, ঘুমন্ত বনের মধ্য দিয়ে ঝরনা বয়ে চলে।
»বিজন দেশ, কূজন নাই
নিজের পায় বাজাই তাল,
একলা গাই, একলা ধাই,
দিবস রাত, সাঁঝ সকাল।
ব্যাখ্যাঃ জনশূন্য স্থানের মধ্য দিয়ে বয়ে চলার সময় ঝরনা আপম ছন্দে এগিয়ে যায়। সেখানে পাখির কলকাকলি নেই। রাত দিন সে নির্জনতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় ।
» বঁকিয়ে ঘাড় ঝুম-পাহাড়
ভয় দ্যাখায়, চোখ পাকায়;
শঙ্কা নাই, সমান যাই,
টগর-ফুল-নূপুর পায়,
কোন গিরির হিম ললাট
ঘামল মাের উদ্ভবে,
কোন পরীর টুটুল হার
কোন নাচের উৎসবে।
ব্যাখ্যাঃ নির্জন পাহাড় ঘাড় বাঁকিয়ে চোখ পাকিয়ে ঝরনাকে ভয় দেখায়। কিন্তু সে সমস্ত ভয় উপেক্ষা করে ছুটে চলে। প্রকৃতির অনুপম সৌন্দর্য বিস্তার করতে করতে সে শঙ্কাহীনভাবে সমান তালে সামনে এগিয়ে যায়। চলার পথে ঝরনা তার সৃষ্টির রহস্য মনে রাখে না। কোন পাহাড়ের বরফ গলে তার সৃষ্টি সে তার খেয়াল না করেই আপন ছন্দে কেবল সামনে ধেয়ে চলে ।
» খেয়াল নাই নাই রে ভাই
পাই নি তার সংবাদই,
ধাই লীলায়,- খিলখিলাই
বুলবুলির বােল সাধি
ব্যাখ্যাঃ ঝরনা আত্মভােলার মতাে কেবল ছুটে চলে। নিজের ছন্দেই সে বিভাের, অন্য কোনাে সংবাদ তার কাছে নেই। সে নিজের লীলা-নৃত্য, ছন্দ নিয়েই ব্যস্ত। নিজেই সে হাসি-আনন্দে মত্ত। খুশিতে সে পাখির গান করে, বুলবুলির বােল সাধে।
» বন-ঝাউয়ের ঝােপগুলায়
কালসারের দল চরে,
শিং শিলায়-শিলার গায়,
ডালচিনির রং ধরে।
ব্যাখ্যাঃ বনে ঝাউগাছের ঝােপগুলাের পাশ দিয়ে চলার সময় চরে বেড়ানাে কালাে হরিণের দল দেখে। সেগুলােতে যেন ডালচিনির রং লেগে থাকে। সেগুলােকে দেখতে দেখতে ঝরনা এগিয়ে যায় ।
» ঝাপিয়ে যাই, লাফিয়ে ধাই,
দুলিয়ে যাই অচল-ঠাট,
নাড়িয়ে যাই, বাড়িয়ে যাই
টিলার গায় ডালিম-ফাট।
ব্যাখ্যাঃ ঝরনা চলার পথে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ছুটে চলে। তখন অচল, অসার বস্তুকেও সে জাগিয়ে তােলে, তাকে নাড়া দেয়। ঝরনা তার চলার আঘাতে টিলার গায়ে ডালিম-ফাটের চিহ্ন রেখে যায়। নিস্তব্দ পাহাড়ে ঝরনাই একমাত্র চলা, মুখরা সত্তা।
» শালিক শুক বুলায় মুখ।
থল-ঝাঝির মখমলে,
জরির জাল আংরাখায়
অঙ্গ মাের ঝলমলে।
ব্যাখ্যাঃ ঝরনা চলার পথে অনতিদূরে স্থলে, জলজ গুল্মের মধ্যে শালিকটিয়ের মুখ বুলিয়ে নিতে দেখে। সেই সৌন্দর্য ঝরনা আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছে। তার অঙ্গে জড়ানাে জরির কারুকাজ করা ঢিলাঢালা লম্বা পােশাক তাকে আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তােলে।
»নিম্নে ধাই, শুনতে পাই
ফটিক জল। হাঁকছে কে,
কণ্ঠাতেই তৃষ্ণা যার
নিক না সেই পাক ঘেঁকে।
ব্যাখ্যাঃ ঝরনা ক্রমাগত নিচের দিক ধেয়ে যায়। চাতক পাখির ডাক সে শােনে। যার তৃষ্ণা পেয়েছে সে পাক ঘেঁকে জল পান করতে চাইলে করুক।
» গরজ যার জল সাঁচার
পাতকুয়ায় যাক না সেই,
সুন্দরের তৃষ্ণা যার
আমরা ধাই তার আশেই।
ব্যাখ্যাঃ জল সংগ্রহ করার আগ্রহ যার বেশি সে পাতকুয়ায় যাক। সেখান থেকে জল পান করে তৃষ্ণা দূর করুক। ঝরনার তাদের দরকার নেই। যারা সৌন্দর্য উপভােগ করতে চায়, ঝরনা তাদের আশায়ই ছুটে চলে।