আমি কোন আগন্তুক নই কবিতার মূলভাব ও ব্যাখা

আমি কোন আগন্তুক নই কবিতার মূলভাব

‘আমি কোনাে আগন্তুক নই’ কবিতায় কবি জন্মভূমির সঙ্গে তার নিজের বন্ধন ও মানুষের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের দিকটি তুলে ধরেছেন। এখানে গ্রামীণ জনপদের সঙ্গে নিবিড় বাধনে বাধা মানুষের জীবনাচরণ ফুটে উঠেছে। গ্রামীণ প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গে কবির প্রাত্যহিক জীবনের সম্পৃক্ততার দিকটি প্রকাশ পেয়েছে। গ্রামের মাঠ-ঘাট-পথ-প্রান্তরের মতাে খেতের সরু পথ, তার পাশে ধানের সমারােহ, একটু দূরে বিশাল নদীর কিনার কবির মনের ভেতর, অস্থিমজ্জায় গ্রথিত হয়ে আছে। কবির কাছে দেশ মানে আপন সত্তায় অনুভব করা। তিনি নিজেকে কোনাে আগন্তুক নন বলে যে দাবি করেছেন, তার সপক্ষে প্রকৃতির নানা কিছুর সঙ্গে পরিচয়ের কথা বলেছেন। জন্মভূমি, আকাশ, ফুল-পাখি, জোনাকি,  পুকুর, মাছরাঙা সবই তার বহুদিনের চেনা, তারাও তাকে ভালাে করে চেনে। কার্তিকের ধানের মঞ্জরির চিরােল পাতার টলমল শিশির, জোছনা রাতে নিশিন্দার ছায়া, তার সাক্ষী। কবির প্রিয় গ্রামীণ জনপদের মানুষ কদম আলী, জমিলার মা সবাই তাকে স্বজনবলে জানে। তিনি আগন্তুক নন বলেই তারা সবাই তাকে আপন বলেই মানেন। তিনিও এই গ্রামীণ জনপদেই খুঁজে পেয়েছেন আত্মার অস্তিত্ব। ‘আমি কোনাে আগন্তুক নই’ কবিতায় জন্মভূমির মধ্যে শিকড় গেড়ে মানুষ যে সমগ্র দেশকে আপন করে পায়, এই সত্যটিই ধ্বনিত হয়েছে। 

 

আমি কোন আগন্তুক নই কবিতার ব্যাখ্যা

 » আসমানের তারা সাক্ষী

সাক্ষী এই জমিনের ফুল, এই

নিশিরাইত বাঁশবাগান বিস্তর জোনাকি সাক্ষী

সাক্ষী এই জারুল জামরুল, সাক্ষী

ব্যাখ্যাঃ রাতের আকাশে তারা ফোটে, নিচে বাঁশ বাগান। সেই নিঝুম বাঁশবাগানে অসংখ্য জোনাকি আলাে জ্বেলে ঘুরে বেড়ায় । জারুল, জামরুল গাছগুলােও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, মনে হয় ঘুমায়। এসবের সঙ্গে কবির পরিচয় আছে, তেমনি তারাও তাকে চেনে। তাই তারা কবির চিরচেনা সাক্ষী ।

» পুবের পুকুর, তার ঝাঁকড়া ডুমুরের ডালে স্থির দৃষ্টি

মাছরাঙা আমাকে চেনে

আমি কোনাে অভ্যাগত নই

ব্যাখ্যাঃ বাড়ির পূর্ব পাশে পুকুর পাড়ে ঝাঁকড়া ডাল-পাতা নিয়ে এক ডুমুরগাছ দাঁড়িয়ে আছে। শিকারের উপর স্থির দৃষ্টি ফেলে বসে আছে এক মাছরাঙা তার ডালে। এ দৃশ্য কবির খুব পরিচিত। কাজেই এখানে তিনি অভ্যাগত অতিথি বা নতুন অপরিচিত কেউ নন।

» খােদার কসম আমি ভিনদেশি পথিক নই

আমি কোনাে আগন্তুক নই। 

ব্যাখ্যাঃ সাধারণত মানুষ নিজের কথার ওপর অন্যের বিশ্বাস স্থাপন করতে গিয়ে কসম করে। কবিও তেমনি কসম করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করছেন যে, তিনি কোনাে ভিনদেশি পথিক বা পর্যটক  তিনি কোনাে অচেনা আগন্তুকও নন।

» আমি কোনাে আগন্তুক নই, আমি

ছিলাম এখানে, আমি স্বাপ্নিক নিয়মে

এখানেই থাকি আর

এখানে থাকার নাম সর্বত্রই থাকা

সারা দেশে।

ব্যাখ্যাঃ কবি যে দেশে জন্মেছেন, সে দেশটি স্বপ্নময় । সে দেশের গ্রাম, গ্রাম্য প্রকৃতি ও জীবন প্রায় একই ধরনের স্বপ্নের স্পর্শমাখা । কবিও সেই স্বপ্নময়তাকে ধারণ করেই বেড়ে উঠেছে। কারণ তিনি এখানে ছিলেন এবং এখনও সারা দেশের অস্তিত্বের সঙ্গেই তিনি মিশে আছেন।

» আমি কোনাে আগন্তুক নই। এই

খর রৌদ্র জলজ বাতাস মেঘ ক্লান্ত বিকেলের

পাখিরা আমাকে চেনে।

তারা জানে আমি কোনাে আত্মীয় নই।

ব্যাখ্যাঃ গ্রীষ্মে এ দেশ খর রােদে ঝলসে যায়। আবার বর্ষায় জলজ বাতাস বয়। আকাশে মেঘ জমে। বর্ষণক্লান্ত বিকেলে পাখিরা উড়ে যায় নীড়ে। ঋতুর পরিবর্তনে প্রকৃতিতে নানা পরিবর্তন সূচিত হয়। কবি সেসব পরিবর্তন বছরের পর বছর দেখে আসছেন। কাজেই কবি বাইরের কোনাে আত্মীয় নন। সবাই তাকে চেনে এবং জানে।

» কার্তিকের ধানের মঞ্জরী সাক্ষী

সাক্ষী তার চিরােল পাতার

টলমল শিশির- সাক্ষী জ্যোৎস্নার চাদরে ঢাকা

নিশিন্দার ছায়া

ব্যাখ্যাঃ কার্তিক মাসে এ দেশের সবুজ ফসলের মাঠ ধানের শিষে ভরে যায়। চিরােল পাতায় টলমল করে শিশির। ধবধবে সাদা জোছনার আলােকে কবি ‘জ্যোৎস্নার চাদর কল্পনা করেছেন। সেই জোছনায় ঢেকে যায় নিশিন্দা জাতীয় গাছ- বনভূমি।

» অকাল বার্ধক্যে নত কদম আলী

তার ক্লান্ত চোখের আঁধার

আমি চিনি, আমি তার চিরচেনা স্বজন একজন।

ব্যাখ্যাঃ এ দেশের গ্রামে অভাব আছে, দারিদ্র্য আছে। রােগে-শােকে জরাজীর্ণ মানুষ আছে, যারা কদম আলীর মতাে অকাল বার্ধক্যে নুয়ে পড়েছে। তারা ক্ষুধায় ক্লান্ত। তাদের চোখে নেমে এসেছে আঁধার। তাদের সঙ্গে কবির নিত্য ওঠা-বসা। তিনি তাদের একজন চিরচেনা আপনজন।

> আমি জমিলার মা’র

শূন্য খা খা রান্নাঘর শুকনাে থালা সব চিনি

সে আমাকে চেনে।

ব্যাখ্যাঃ জমিলার মায়ের মতাে স্বজনহীন, কর্মহীন, অভাবী, অসহায়  মানুষকে কবি চেনেন। তাদের ঘরে খাবার নেই। রান্না হয় না,  শূন্য খাবারের থালা সেখানে শুকনাে পড়ে থাকে। কাজ  জোটাতে পারে না বলে খাদ্যও জোটে না তাদের। এদের সঙ্গে কবির পরিচয় অত্যন্ত নিবিড় এবং গভীর।

» হাত রাখাে বৈঠায় লাঙলে, দেখাে

আমার হাতের স্পর্শ লেগে আছে কেমন গভীর।

ব্যাখ্যাঃ নদীমাতৃক এ দেশে নৌকার প্রচলন বহুকাল থেকেই। অনেক  মানুষ এখনও নৌকা চালায়, মাছ ধরে, পণ্য আনা-নেওয়া করে। এদেশের অধিকাংশ মানুষ কৃষিজীবী। তারা লাঙল দিয়ে জমি চাষ করেন। কবি অনুভব করেন, যে লাঙল  জমিতে ফসল ফলায়, যে বৈঠা দিয়ে নৌকা বাওয়া হয়। সেগুলােতে তার হাতের ছোঁয়া লেগে আছে। কাজেই তিনি কারও অচেনা কেউ নন।

» দেখাে মাটিতে আমার গন্ধ, আমার শরীরে

লেগে আছে এই সিদ্ধ মাটির সুবাস।

আমাদের বিশ্বাস করাে, আমি কোনাে আগন্তুক নই।

ব্যাখ্যাঃ এদেশের মাটির সঙ্গে কবির নিবিড় সম্পর্ক। তিনি জন্মেছেন। এদেশের মাটিতে; খেলেছেন এবং এ মাটিতেই বেড়ে উঠেছেন। মাটির স্নিগ্ধ সুবাস এখনও তার শরীরে লেগে আছে। তিনি এ দেশের চিরচেনা মাটি থেকে কখনাে বিচ্ছিন্ন হতে পারবেন না । কারণ তিনি বাইরে থেকে আসেননি, তিনি কোনাে আগন্তুকও নন।

» দু’পাশে ধানের ক্ষেত

সরু পথ

সামনে ধু ধু নদীর কিনার

আমার অস্তিত্বে গাঁথা। আমি এই উধাও নদীর

মুথ এক অবােধ বালক।

ব্যাখ্যাঃ কবির স্বদেশের গ্রামের দু’পাশে সবুজ বিস্তীর্ণ ধানের খেত। ঝিকিমিকি নদী, নদীর কিনারে ধু ধু বালুর চর, সরু আলপথ— এ সবকিছুই তার চিরচেনা, অস্তিত্বের সঙ্গে গাঁথা। এ অপরূপ প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যে তিনি মুগ্ধ। এসব সৌন্দর্য-তরঙ্গ কবির অস্থি-মজ্জার সঙ্গে এক হয়ে আছে।  

Leave a Comment