আমার পরিচয় কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর

প্রশ্ন ১। ইংরেজ শাসকদের কাছ থেকে উপমহাদেশের মুক্তির জন্য মহাত্মা গান্ধী এক সময় এদেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেন। নানাভাবে তাদের মাঝে দেশপ্রেম জাগ্রত করার চেষ্টা করেন। এরই ধারাবাহিক ফসল স্বদেশী আন্দোলন, অহিংস আন্দোলন ইত্যাদি। কালের বিবর্তনে জন্ম পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি পৃথক রাষ্ট্রের এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের।

ক. বৌদ্ধবিহার কোথায় অবস্থিত?

খ. “আমি তাে এসেছি কমলার দীঘি’, ‘মহুয়ার পালা’ থেকে।”- এ কথা দ্বারা কবি কী বােঝাতে চেয়েছেন?

গ. উদ্দীপকটি ‘আমার পরিচয়’ কবিতার সাথে যেদিক দিয়ে সাদৃশ্যপূর্ণ তা ব্যাখ্যা কর।

ঘ. উদ্দীপকটি ‘আমার পরিচয়’ কবিতার খণ্ডাংশ মাত্র, পূর্ণচিত্র নয়।” যুক্তিসহ লেখ।

১নং প্রশ্নের উত্তর

ক। বৌদ্ধবিহার বর্তমান নওগাঁ জেলার বদলগাছি থানায় পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত।

খ। “আমি তাে এসেছি কমলার দীঘি’, ‘মহুয়ার পালা’ থেকে।”- এ কথা দ্বারা কবি বাংলার সাংস্কৃতিক বিবর্তন ধারাকে বুঝিয়েছেন।

‘আমার পরিচয়’ কবিতায় কবি গভীর মমত্বের সঙ্গে কবিতার আঙ্গিকে চিত্রিত করেছেন আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পটভূমি। কমলার দীঘি’, ‘মহুয়ার পালা’ মৈমনসিংহ গীতিকার দুটি পালা। এই পালাগুলােতে গ্রামীণ নর-নারীর সহজ-সরল প্রেমকাহিনি তুলে ধরা হয়েছে। এতে নারীর মূল্য, মর্যাদা, ব্যক্তিত্ব, স্বাতন্ত্র প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য প্রকাশমান। এক অপূর্ব সুন্দরী বেদেকন্যা মহুয়ার সঙ্গে বামনকান্দার জমিদার ব্রাহ্মণ যুবক নদের চাঁদের দুর্জয় প্রণয়কাহিনি অবলম্বনে ‘মহুয়ার পালা রচিত।

গ। উদ্দীপকটি “আমার পরিচয় কবিতায় প্রতিফলিত বিপ্লব-বিদ্রোহের মতাদর্শের দিক দিয়ে সাদৃশ্যপূর্ণ।

মূলত ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার শেষ সূর্য অস্তমিত হয়। এরপর ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিপ্লব, ১৯৩০ সালে ব্রিটিশবিরােধী সশস্ত্র যুদ্ধ, ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। এভাবে ইতিহাসের বহু অধ্যায় পার হয়ে, নানা সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে এদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে।

উদ্দীপকে বিশ্বের বুকে একটি মর্যাদাবান জাতি-রাষ্ট্র গঠনে এদেশের মানুষকে স্বদেশপ্রেমে জাগ্রত করতে মহাত্মা গান্ধীর কৃতিত্ব সম্পর্কে ইঙ্গিত করা হয়েছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে একান্ত আপন করে নিয়ে, পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তিনি। তার এ আহ্বান আলােচ্য আমার পরিচয়” কবিতার বিপ্লব-বিদ্রোহের মতাদর্শের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। কবিতায় কবি সৈয়দ শামসুল হক এদেশের অস্তমিত স্বাধীনতার সূর্যকে আবার উদয়ের পথে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের কথা বলেছেন। তিনি কবিতায় বৌদ্ধ কবিদের সৃষ্ট চর্যাপদের মধ্যে বাঙালি জাতিসত্তার অসাম্প্রদায়িক জীবনবােধের পরিচয়, যুগে যুগে নানা আন্দোলন, বিপ্লব-বিদ্রোহ ও রাজনৈতিক মতাদর্শের বিকাশধারায় আজকের বাংলায় পৌছানাের কথা বলেছেন। সেই ধারায় মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনটি একটি শ্রেষ্ঠ পদক্ষেপ। এভাবে আলােচ্য বিষয়টি কবিতার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

ঘ। উদ্দীপকটি ‘আমার পরিচয় কবিতার খণ্ডাংশ মাত্র, পূর্ণচিত্র নয়।”- মন্তব্যটি যথার্থ।

বাঙালি জাতিসত্তার অতীত ঐতিহ্য আছে। তা এক দিনে বা একক কোনাে ঘটনার মধ্য দিয়ে আসেনি। ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতির ধারাপ্রবাহে তার আগমন। এই ধারাপ্রবাহ ধরেই আমাদের সামগ্রিক সত্তা। এ কারণেই ঐতিহ্য সংলগ্ন এক স্বাধীন জাতি বলে নিজেদের পরিচয় দিতে আমরা গর্ববােধ করি।

উদ্দীপকে ব্রিটিশ শাসনের অবসানকল্পে এদেশের সাধারণ মানুষকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ স্বদেশী আন্দোলন গড়ে তুলতে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বের দিকটি তুলে ধরা হয়েছে। এদেশের পতিত, চণ্ডাল, ছােটলােকদের ভাই বলে বুকে টেনে নিয়ে তাদেরকে শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানাের সাহস জুগিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। জনতাও তাঁর আহ্বানে সাড়া য়েছিল। জনতার সেই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশ শাসকরা টিকতে পারেনি। গান্ধীজির অহিংস আন্দোলনের সঙ্গে বিপ্লবের ধারাবাহিক চেতনাটি সাদৃশ্যপূর্ণ। যেখানে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি আছে। এই বিষয়টি ছাড়াও কবিতায় চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্য যাত্রা, কৈবর্ত বিদ্রোহ, পালযুগের চিত্রকলার বিকাশ সাধন, বৌদ্ধবিহারের জ্ঞানচর্চা, মুসলিম ধর্ম ও সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশ, বারাে ভূইয়াদের উত্থান, মৈমনসিংহ গীতিকায় প্রতিফলিত মানুষের জীবন, তিতুমীর-হাজী শরীয়তউল্লাহর বিদ্রোহ, রবীন্দ্র-নজরুলের কালজয়ী সৃষ্টি ইত্যাদি বিষয় বর্ণিত হয়েছে।

‘আমার পরিচয়’ কবিতায় আত্মমর্যাদাবােধসম্পন্ন বাংলার স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ও জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার পশ্চাতের এক ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে, যা আলােচ্য উদ্দীপকে নেই। এমনকি ইঙ্গিতেও প্রকাশ পায়নি। আমার পরিচয়’ কবিতার মধ্যে কবি এই বিপুল বাংলাদেশের অনবদ্য রূপটি তুলে ধরেছেন। তাই উদ্দীপকটি “আমার পরিচয়’ কবিতার খণ্ডাংশ মাত্র, পূর্ণচিত্র নয়।

 

প্রশ্ন ২। হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান

অবান্তর আজ এ প্রশ্ন

আমরা সবাই বাঙালি

বাংলা মায়ের সন্তান

এ কথাই অগ্রগণ্য।

আমাদের পরিচয় ধর্মে নয়

কর্মে পরিচয় পাইআমরা সবাই মানুষ

এটাই আমাদের শেষ পরিচয়।

ক. বাংলাদেশের শিল্পকলা আন্দোলনের পথিকৃৎ কে?

খ. “আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে” বলতে কী বােঝানাে হয়েছে?

গ. উদ্দীপকটি আমার পরিচয়’ কবিতার কোনে দিকটির সাথে সম্পর্কযুক্ত? ব্যাখ্যা কর।

ঘ. “আমরা সবাই মানুষ এটাই আমাদের শেষ পরিচয়।”- পঙক্তিটি আমার পরিচয়’ কবিতার আলােকে বিশ্লেষণ কর।

২নং প্রশ্নের উত্তর

ক। বাংলাদেশে শিল্পকলা আন্দোলনের পথিকৃৎ হলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন।

খ।  “আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে” বলতে স্বাধীনতা অর্জনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠের প্রেরণাকে বােঝানাে হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ‘জয় বাংলা ধ্বনি একদিন বাংলার মানুষের প্রাণে সাড়া জাগিয়েছিল। তাদের স্বাধীনতার আকক্ষাকে জাগিয়ে তুলে বুকে অসীম সাহস এনে দিয়েছিল। মহান নেতার অনুপ্রেরণায় বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরােধ গড়ে তােলে। যার যা কিছু আছে তা নিয়েই মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে এবং বাংলাদেশকে স্বাধীন করে। বাঙালির স্বাধীন সত্তা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জয় বাংলা’ স্লোগানের শক্তি সারের বিষয়টিই প্রশ্নোক্ত লাইনটিতে ফুটে উঠেছে।

গ। ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় বাঙালির যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিচয় পাওয়া যায় তার সঙ্গে উদ্দীপকটি সম্পর্কযুক্ত।

জাতি, বর্ণ বা ধর্মের কারণে সৃষ্ট কৃত্রিম ভেদাভেদ সমাজকে খণ্ড-বিখণ্ড করে, এর ফলে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণের মানুষ বাস করলেও তারা অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক। তাই যুগ যুগ ধরে তারা মিলেমিশে বসবাস করে আসছে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিপদকে মােকাবিলা করেছে, সংগ্রাম করেছে।

‘আমার পরিচয়’ কবিতার মূলভাবে বাঙালির এই অসাম্প্রদায়িক চেতনাই মূর্ত হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন ধর্মের মানুষ একে অপরকে ভালােবেসে এক হয়েছে বিপদে, সংগ্রামে, সুখে-দুঃখে, যার পরিচয় ফুটে উঠেছে বাংলা সাহিত্যে। বাঙালি পরিচয়েই তারা যুদ্ধ করেছে অপশক্তির বিরুদ্ধে, স্বাধীন করেছে দেশকে। উদ্দীপকেও বলা হয়েছে যে, বাঙালির পরিচয় ধর্মে নয়, কর্মে। কবি এখানে বাংলার মানুষের অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বাঙালি অসাম্প্রদয়িক চেতনাকে ধারণ করে। তারা মানুষ পরিচয়কেই বড় করে দেখে। এই চেতনায় বিশ্বাস করেই তারা ঐক্যবদ্ধ হয়। ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় এই চেতনায় বাঙালির একাত্ম হওয়ার দিক থেকে উদ্দীপকটি এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

ঘ। “আমরা সবাই মানুষ/এটাই আমাদের শেষ পরিচয়।”- “আমার পরিচয়’ কবিতার আলােকে পঙক্তিটি গভীর তাৎপর্যমণ্ডিত।

ধর্ম, বর্ণ বা জাতিগত বিভেদ মানুষের সত্যিকার পরিচয় খর্ব করে। তাই এগুলাে কখনাে মানুষের প্রকৃত সত্তার পরিচায়ক হতে পারে| এই সংকীর্ণতার গণ্ডিতে বাঙালি আবদ্ধ নয়, সবকিছুর ঊর্ধ্বে সে তার মানুষ পরিচয়েই বিশ্বাসী।

আমার পরিচয়’ কবিতায় কবি বাঙালি জাতিসত্তার অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জীবনবােধকে নির্দেশ করেছেন। একই সঙ্গে এদেশে যে বিভিন্ন ধর্মের চর্চাহয়েছে, বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বিশ্বাস ও মতাদর্শ বিস্তার লাভ করেছে সে কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে বাঙালির মাঝে কোনাে দ্বন্দ্ব-বিভেদ তৈরি হয়নি। কারণ তারা বিশ্বাস করে মানবতাই তাদের প্রকৃত সত্তা। উদ্দীপকের কবিতাংশেও এই মনােভাব প্রকাশিত হয়েছে। কে কোন ধর্মে বিশ্বাসী সেসব নিশ্চিহ্ন হয়েছে জাতির সংকটের মুহূর্তে। সবাই এক মানুষ পরিচয়েই বিশ্বাসী, বাঙালি মায়ের সন্তান হতে পারাটাই তাদের কাছে অত্যন্ত আনন্দ ও গর্বের। ধর্মবিশ্বাস যদি অন্ধ হয় তবে তা মানুষের জন্য ক্ষতিকর। কারণ এই অন্ধবিশ্বাসীরাই বিভেদ তৈরি করে মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে। বাঙালি তার হৃদয়ের মহত্ত্বে এই সংকীর্ণতাকে অতিক্রম করেছে, তারা বিশ্বাস করে যে তারা মানুষ এবং এটিই তাদের আসল পরিচয়। প্রশ্নোক্ত বাক্যে এবং আমার পরিচয়’ কবিতায় এ ভাবটি প্রাধান্য পেয়েছে।

 

প্রশ্ন ৩। আমরা বাঙালি। আত্মমর্যাদাবােধসম্পন্ন এই জাতির রয়েছে সমৃদ্ধ অতীত ইতিহাস। জাতি হিসেবে আমাদের বর্তমান যে পরিচয় তা এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। যুগে যুগে নানা আন্দোলন, বিপ্লব-বিদ্রোহ আর মতাদর্শের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি এ পরিচয় লাভ করেছে।

ক. বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন কী?

খ. ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’- কবি এ কথা বলেছেন কেন?

গ. উদ্দীপকে উল্লিখিত নানা আন্দোলন ও বিপ্লব-বিদ্রোহের পটভূমি আমার পরিচয়’ কবিতার আলােকে বিশ্লেষণ কর।

ঘ. আমার পরিচয় কবিতার সমগ্র ভাব উদ্দীপকে প্রতিফলিত হয়নি- তােমার মতামত দাও।

৩নং প্রশ্নের উত্তর

ক। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ’।

খ। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’- কবি এ কথা বলেছেন মানুষের মর্যাদা এবং ধর্মীয় দিক থেকে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে বােঝানাের জন্য।

আমাদের এই দেশে নানা ধর্মের মানুষ মিলেমিশে বাস করে। এখানে সবার এক পরিচয় সবাই বাঙালি। বাঙালি কোনাে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিতে বিশ্বাস করে না। তারা মানবিকবােধে উন্নত এবং সহনশীল। তাই ধর্ম নয়, এখানে মানবসত্তাই তাদের কাছে প্রধান হয়ে উঠেছে। বাঙালির এই মানবিকবােধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা কবির প্রশ্নোক্ত বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে। মানুষ হিসেবে মানুষের পরিচয়ই কবির কাছে মুখ্য, ধর্ম নয়।

গ। ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় কবি নানা বিপ্লব ও বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির উত্থানের প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরেছেন, যা উদ্দীপকেও লক্ষ করা যায়।

বহুকাল থেকে নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে বাঙালি বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে। ঘরের শত্রু ও বাইরের শত্রুকে পরাভূত করে বাঙালি বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। তাই বাঙালির জীবনের বাঁকে বাঁকে রয়েছে বিপ্লব, বিদ্রোহ আর সংগ্রাম।

‘আমার পরিচয়’ কবিতায় কবি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র ও বাঙালি জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার পশ্চাতে যে বিপ্লব-বিদ্রোহ রয়েছে তার পরিচয় বিবৃত করেছেন। কৈবর্ত বিদ্রোহ, তিতুমীর আর হাজী শরীয়তউল্লাহর বিদ্রোহ, ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং সবশেষে স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আজকের বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। এই বিপ্লব আর বিদ্রোহ বাঙালি জাতিকে এক নতুন পরিচয়ে পরিচিত করেছে, আর তা হলাে বাঙালি হার না-মানা জাতি’। উদ্দীপকেও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে বাঙালি জাতির পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। যুগে যুগে নানা আন্দোলন, বিপ্লব-বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে বাঙালি এ পরিচয় লাভ করেছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা তার ভিত্তি রচিত হয়েছিল সুদূর অতীতকালে। অতীতের এসব বিপ্লব-বিদ্রোহের পটভূমি হলাে বাঙালির স্বাধীনতার প্রত্যাশা, মুক্তির প্রত্যাশা।

ঘ। ‘আমার পরিচয়’ কবিতার সমগ্র ভাব উদ্দীপকে প্রতিফলিত হয়নি- মন্তব্যটি যথার্থ।

বাঙালি জীবনের প্রতিটি পরিবর্তন ও অর্জনের বাঁকে বাঁকে মিশে আছে বিপ্লব, বিদ্রোহ ও সংগ্রাম। এগুলাে কখনাে বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে, আবার কখনাে দেশি শােষকের বিরুদ্ধে। তবে সব ক্ষেত্রেই তারা সাহস আর বীরত্বে অন্যায়কে প্রতিহত করেছে। 

‘আমার পরিচয়’ কবিতায় কবি বাঙালির বীরত্ব, সাহসিকতা ও দৃঢ়তার দিক তুলে ধরেছেন। অন্যায়, শাসন ও শােষণের বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহ করে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জীবনবােধ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতিটি পর্যায়ে মিশে আছে তাদের বিপ্লবী চেতনা। উদ্দীপকেও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন বাঙালি জাতির স্বাধীনচেতা ও সংগ্রামী চেতনার পরিচয়ই বিবৃত হয়েছে। জাতি হিসেবে বাঙালির এই যে পরিচয় তা দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল। এর মধ্য দিয়েই বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠা।

উদ্দীপকে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে বাঙালির প্রতিষ্ঠার দিকটি বর্ণিত হয়েছে, যা আমার পরিচয়’ কবিতায়ও প্রতিফলিত হয়েছে। তবে কবিতায় বাঙালির সাহিত্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির যে পরিচয় কবি দিয়েছেন তা আলােচ্য উদ্দীপকে নেই। তাই বলা হয়েছে যে, আলােচ্য কবিতার সমগ্র ভাব উদ্দীপকে প্রতিফলিত হয়নি।

 

প্রশ্ন ৪। বহু প্রাচীনকাল থেকেই আমরা বাঙালিরা শত্রুর সাথে যুদ্ধ করে এদেশে টিকে আছি। ইংরেজদের অত্যাচার, পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ, সকল অনাচারকে শক্তি, সাহস ও মনােবল দিয়ে প্রতিহত করেছি। এখন আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি। এ স্বাধীনতা লাখাে শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে। আমরা তাদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ।

ক. চর্যাপদ কে আবিষ্কার করেন?

খ. কবি বারাে ভূঁইয়াদের প্রসঙ্গ এনেছেন কেন?

গ. উদ্দীপকে ‘আমার পরিচয়’ কবিতার কোন দিকটি প্রকাশ পেয়েছে ব্যাখ্যা কর।

ঘ, “উদ্দীপকটি আমার পরিচয়’ কবিতার আংশিক প্রতিফলন মাত্র।”- মূল্যায়ন কর।

৪নং প্রশ্নের উত্তর

ক। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদ আবিষ্কার করেন।

খ। বাঙালির সুদীর্ঘ কালের ঐতিহ্য তুলে ধরার জন্য কবি বারাে ভূঁইয়াদের প্রসঙ্গ এনেছেন।

ঐতিহাসিকতার দিক থেকে দেখা যায়, ১৫৭৫ সালে মােগল সম্রাট আকবর বাংলা জয় করার পরও যে কয়জন স্বাধীন জমিদার ঈশা খাঁর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মােগল শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান তারাই বারাে ভূইয়া নামে পরিচিত। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন ঈশা খা, চাঁদ রায়, কেদার রায়, প্রতাপাদিত্য, লক্ষ্মণ মাণিক্য প্রমুখ। সংগ্রামী মনােভাব ও বীরত্বের জন্য তারা ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন। বাঙালির এ স্বাধীনচেতা মনােভাব ও সাহসী চেতনাকে তুলে ধরতে কবি ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় বারাে ভূঁইয়াদের প্রসঙ্গ এনেছেন ।

গ। ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় অত্যাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বাঙালির অবস্থানের বিষয়টি উদ্দীপকে ফুটে উঠেছে।

বাঙালি সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। যখনই তার ওপর অন্যায়-অত্যাচারের খড়গ নেমে এসেছে তখনই সে বিদ্রোহ করেছে। এভাবেই শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রতিনিয়ত তারা দৃঢ় করেছে তাদের অবস্থান। আর এই দৃঢ়তা ও সংগ্রামী চেতনার পথ ধরেই এসেছে স্বাধীনতা।

‘আমার পরিচয় কবিতায় কবি বাঙালি জীবনের বাঁকে বাঁকে বিদ্রোহের যে ইতিহাস আছে তা তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশ নামক এই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পিছনে আছে বাঙালির আপসহীন, বিদ্রোহী ও সংগ্রামী মনােভাব। তারা অন্যায়ের কাছে পরাস্ত হয়নি বলেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। উদ্দীপকেও বাঙালি জীবনের এ দিকটি প্রতিফলিত হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজ অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। এর সর্বশেষ প্রমাণ- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। পাকিস্তানি সেনাদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসযজ্ঞ ও অন্যায়কে বাঙালি সাহস ও মনােবল দিয়ে প্রতিহত করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে।

ঘ। উদ্দীপকটি আমার পরিচয় কবিতার আংশিক প্রতিফলন মাত্র।”- মন্তব্যটি যথার্থ ।

বাঙালির জীবনের প্রতিটি বাঁকেই আছে সংগ্রামের এক-একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস। বিভিন্ন সময় বহিঃশত্রু তাদের আক্রমণ করেছে। সেই আক্রমণ তারা সাহস ও শক্তি দিয়ে প্রতিহত করেছে।

‘আমার পরিচয়’ কবিতায় বাঙালি জীবনের সংগ্রামী দিকটি বর্ণনার পাশাপাশি কবি বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরেছেন। বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতির পরিচয়ও পাওয়া যায় ‘চর্যাপদ’, ‘গীতাঞ্জলি’, ‘অগ্নিবীণা’, ‘মহুয়ার পালা’ প্রভৃতির মধ্য দিয়ে। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জীবনবােধ, সাম্যবাদী মনােভাবও এখানে বাণীরূপ লাভ করেছে। অন্যদিকে উদ্দীপকে আমরা বাঙালির বিদ্রোহী ও সংগ্রামী জীবনের পরিচয় পাই। শত্রুর কালাে থাবাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাঙালি নিজ ভূমিতে আপন মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে। লাখাে শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা।

সংগ্রাম, বিদ্রোহ, বিপ্লব বাঙালির সত্তায় মিশে আছে, ইতিহাসও সেই প্রমাণ দেয়। উদ্দীপক ও আমার পরিচয়’ কবিতায় বাঙালি চরিত্রের এ দিকটি ফুটে উঠেছে। তবে আলােচ্য কবিতায় বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিচয়ও বিধৃত হয়েছে, যা উদ্দীপকে নেই। এ কারণেই প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটিকে যথার্থ বলা হয়েছে।

 

প্রশ্ন ৫। হিন্দু-মুসলিম দুটি ভাই

ভারতের দুই আঁখিতারা।

এক বাগানের দুটি তরু

দেবদারু আর কদমচারা।

যেন গঙ্গা সিন্ধু নদী

যায় গাে বহে নিরবধি।

এক হিমালয় হতে আসে

এক সাগরে হয় গাে হারা।

ক. ‘কৈবর্ত বিদ্রোহ’ কার বিরুদ্ধে হয়েছিল?

খ. বাঙালি জাতির বীজমন্ত্র বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?

গ. উদ্দীপকে ‘আমার পরিচয় কবিতার কোন দিকটি ইঙ্গিত করা হয়েছে, তা ব্যাখ্যা কর।

ঘ. উদ্দীপকে ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় বাঙালির পরিচয়ের খণ্ডাংশের প্রতিফলন ঘটেছে বিশ্লেষণ কর।

৫নং প্রশ্নের উত্তর

ক। কৈবর্ত বিদ্রোহ হয়েছিল মহীপালের বিরুদ্ধে।

খ। বাঙালি জাতির বীজমন্ত্র বলতে আমার পরিচয় কবিতায় কবি ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’- এই মানবতাবােধকে বুঝিয়েছেন।

বাঙালি জাতি চিরকালই উদারচেতা। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে বাঙালি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। মানুষকে সবার উপরে স্থান দিয়ে তারা মানবধর্ম পালন করে। এক ভূখণ্ডে একাধিক জাতির বসবাস থাকলেও কারও সাথে কারও দ্বন্দ্ব নেই। একজনের বিপদে অন্যজন ঝাপিয়ে পড়ে। নানা ধরনের উৎসব-পার্বণ একই সঙ্গে পালন করে। বিশেষ করে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে এ জাতি ঐক্যবদ্ধ। ফলে সবার উপরে মানুষের অবস্থান। বাঙালি জাতি মানুষকে সর্বজীবের উপরে স্থান দেওয়াকে বীজমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করে আবহমানকাল ধরে একসঙ্গে সৌহার্দ ও সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করে আসছে। বালিকে নির্দেশ করেছেন।

গ। উদ্দীপকে ‘আমার পরিচয়’ কবিতার অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।

আবহমান বাংলা অভিন্ন সংস্কৃতি, ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঋদ্ধ। বাংলার ভূখণ্ডে নানা জাতি-ধর্মের লােক বাস করে। কিন্তু জাতি-ধর্মের পার্থক্য এখানকার মানুষের জীবনে কোননা দেয়াল তৈরি করেনি। একে অন্যের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে বেঁধে তারা জীবন অতিবাহিত করছে।

উদ্দীপকের কবিতাংশে অসাম্প্রদায়িক চেতনার দিকটি পরিলক্ষিত হয়। কবি এখানে হিন্দু-মুসলমানকে ভারতের দুটি ভাই এবং দেশমাতার দুই চোখের তারা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। গঙ্গা ও সিন্ধু নদীর উৎসমূল যেমন এক হিমালয় তেমনই হিন্দু-মুসলিমও একই বৃন্তের দুটি ফুল।

উদ্দীপকের মতাে এই অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে আমার পরিচয়’ কবিতায়। চর্যাপদের মধ্যে বাঙালি জাতিসত্তার যে অসাম্প্রদায়িক জীবনবােধের পরিচয় পাওয়া যায়, তা তুলে ধরা হয়েছে এ কবিতায়। যুগে যুগে নানা আন্দোলন, বিপ্লব-বিদ্রোহ আর মতাদর্শের বিকাশ হতে হতে আমরা এসে পৌঁছেছি আজকের বাংলায়। কবিতার এ দিকটির ইঙ্গিত করা হয়েছে আলােচ্য উদ্দীপকে।

ঘ। উদ্দীপকে ‘আমার পরিচয়’ কবিতার বাঙালির পরিচয়ের খণ্ডাংশের প্রতিফলিন ঘটেছে- মন্তব্যটি যথার্থ।

আবহমান বাংলা অভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার বৈশিষ্ট্যে ঐতিহ্যমণ্ডিত। বাংলার ভূখণ্ডে নানা সম্প্রদায়ের লােক বাস করে। এখানে বংশপরম্পরায় বসবাসকারী জনগােষ্ঠীর ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, অভ্যাস, আচার, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও শিল্পসাহিত্য তাদেরকে একটি স্বতন্ত্র জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ করে।

উদ্দীপকে বাঙালি জাতির অসাম্প্রদায়িক চেতনার দিকটি ফুটে উঠেছে। কবি এখানে হিন্দু-মুসলমানকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে বেঁধে দেশমাতার চোখের তারা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। আমার পরিচয় কবিতায়ও এই অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিষয়টি উপস্থাপিত হয়েছে। তবে এটিই কবিতার একমাত্র বিষয় নয়। এছাড়াও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কবিতায় উপস্থাপিত হয়েছে।

‘আমার পরিচয়’ কবিতায় কবি বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। কবি গভীর মমত্বের সঙ্গে চিত্রিত করেছেন এ জাতির সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পটভূমি। বাঙালির বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে কবি নিজের পরিচয়ের কথা বলেছেন। এ কবিতার এসব বিষয় সম্পূর্ণভাবে উদ্দীপকে উপস্থাপিত হয়নি, শুধু অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিষয়টি ছাড়া। তাই বলা যায়, উদ্দীপকে ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় বাঙালির পরিচয়ের খণ্ডাংশের প্রতিফলন ঘটেছে।

Leave a Comment