আমার পরিচয় কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা

আমার পরিচয় কবিতার মূলভাব

‘আমার পরিচয়’ কবিতায় কবি সৈয়দ শামসুল হক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ও আত্মমর্যাদাবোেধসম্পন্ন জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার নেপথ্যের সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক পটভূমি তুলে ধরেছেন। কবিতায় কবি আত্মপরিচয় নির্দেশ করতে গিয়ে বাঙালির বহু পুরনাে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং সুদীর্ঘ সংগ্রামী ইতিহাস আমাদের সামনে এনেছেন। এতে তাঁর আত্মমর্যাদাবােধ জাগ্রত হয়েছে। হঠাৎ করে পাওয়া বা রাতারাতি গড়ে ওঠা কোনাে বিষয় কবির এই আত্মপরিচয়ের পেছনে কাজ করেনি। তার আত্মপরিচয় এদেশের ঋদ্ধ, সমৃদ্ধ সংগ্রামী ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ঘেরা একটি সমৃদ্ধ পরিচয়। তাঁর আত্মপরিচয়ের সঙ্গে চর্যাপদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্য যাত্রা, পালযুগের চিত্রকলা, বৌদ্ধবিহারের জ্ঞানচর্চা, মুসলিম ধর্ম ও সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশ, জমিদারি প্রথা, মৈমনসিংহ গীতিকার জীবন, কৈবর্ত বিদ্রোহ থেকে শুরু করে তিতুমীর, হাজী শরিয়তুল্লাহ, সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম প্রমুখের বিপ্লব-বিদ্রোহ একাকার হয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথের বিশাল সৃষ্টি, নজরুলের সমস্ত বিদ্রোহী চেতনা ও সাম্যবাদের মুক্তির চেষ্টার সঙ্গেও একাত্ম হয়ে আছে কবির আত্মপরিচয়। তিনি বাঙালির ভাষা আন্দোলনের পথপরিক্রমায় ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যােগ্য নেতৃত্বে মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জনের সঙ্গে আত্মপরিচয়টি জুড়ে দিয়েছেন। আমার পরিচয়’ কবিতায় মূলত ঐতিহ্যমণ্ডিত বাংলাদেশের অনবদ্য রূপটি প্রকাশ পেয়েছে।

 

আমার পরিচয় কবিতার ব্যাখ্যা

» আমি জন্মেছি বাংলায়, আমি বাংলায় কথা বলি,

আমি বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছর চলি।

ব্যাখ্যাঃ কবি বাংলায় জন্মেছেন। বাংলায় কথা বলে তিনি ভাব বিনিময় করেন। তিনি বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছরের পথ পার হয়ে এসেছেন।

» আমি তাে এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।

ব্যাখ্যাঃ প্রাচীনকাল থেকে বড় বড় বাণিজ্যতরিতে করে ব্যবসায়বাণিজ্য করতেন সওদাগরেরা। এখানে মালকাব্যে বর্ণিত চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙা মধুকরের কথা স্মরণ করা হয়েছে।

» আমি তাে এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে।

ব্যাখ্যাঃ বাঙালি জাতির বিদ্রোহের ঐতিহ্য বােঝাতে কৈবর্ত বিদ্রোহের কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিদ্রোহের নেতা ছিলেন কৈবর্ত সম্প্রদায়ের বীর দিব্য বা দিব্বোক । আনুমানিক ১০৭০-১০৭৭ খ্রিষ্টাব্দে মহীপালের বিরুদ্ধে এ বিদ্রোহ করেন অনন্তসামন্ত চক্রের মিলিত শক্তি। ইতিহাসে এটি কৈবর্ত বিদ্রোহ নামে খ্যাত।

» আমি তাে এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।

ব্যাখ্যাঃ কবি এদেশের শিল্পসমৃদ্ধ ঐতিহ্য বােঝাতে পালযুগের চিত্রকলার উল্লেখ করেছেন। ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে গােপালের রাজ্য শাসনের মধ্য দিয়ে বঙ্গে পালযুগের সূচনা হয়। পালদের রাজত্ব চারশত বছর টিকে ছিল। এ সময় শিল্প-সাহিত্যের অসামান্য বিকাশ সাধিত হয়।

» এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সােনা মসজিদ থেকে।

এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।

ব্যাখ্যাঃ কবি বাংলার মুসলিম ঐতিহ্যের সুমহান নিদর্শনের পরিচয় দিতে গিয়ে সােনামসজিদের কথা বলেছেন। অসাধারণ শিল্প সৌন্দর্যমণ্ডিত এই স্থাপত্যকর্ম হােসেন শাহের রাজত্বকালে (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি.) নির্মিত হয়। এটি চাপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্রভূমে অবস্থিত ছােট সােনামসজিদ। একই সঙ্গে কবি আউল-বাউল, মাটির দেউলের কথাও বাঙালির ঐতিহ্য হিসেবে স্মরণ করেছেন।

» আমি তাে এসেছি সার্বভৌম বারাে ভূঁইয়ার থেকে।

আমি তাে এসেছি ‘কমলার দীঘি’ ‘মহুয়ার পালা’ থেকে।

ব্যাখ্যাঃ বাংলার স্বাধীনতা ঘােষণাকারী বারাে ভূঁইয়াদের কথা কবি বিশেষ ঐতিহ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বাংলায় পাঠান করানী বংশের রাজত্ব দুর্বল হয়ে পড়লে স্বাধীন জমিদারদের উত্থান ঘটে। ১৫৭৫ সালে মােগল সম্রাট বাংলা জয় করার পর এই জমিদাররা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ করেন। এঁরাই ইতিহাসে বারাে ভূঁইয়া নামে পরিচিত। লােককাহিনির প্রাচীন ঐতিহ্য হিসেবে কবি ‘কমলার দীঘি’ ও মহুয়ার পালা’র কথা উল্লেখ করেছেন। এ দুটিই মৈমনসিংহ গীতিকার বিখ্যাত পালা।

» আমি তাে এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরিয়ত থেকে।

ব্যাখ্যাঃ অত্যাচারী ইংরেজদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন সংগ্রামকারী বাঙালি বীর হিসেবে তিতুমীরের কথা স্মরণ করেছেন কবি। চব্বিশ পরগনার হায়দরপুর গ্রামে ১৭৮২ সালে মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে শহিদ হন। হাজী শরীয়তউল্লাহ বিদেশি শাসন-শােষণ, জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার থেকে মানুষকে মুক্ত করার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি (১৭৮১-১৮৪০ খ্রি.) মাদারীপুর জেলার শিবচর থানার সামাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ধর্মকে আশ্রয় করে সব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সােচ্চার হন।

» আমি তাে এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে।

ব্যাখ্যাঃ নােবল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি’ ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের অগ্নিবীণা’ বাংলা সাহিত্যের অবিস্মরণীয় কীর্তি। এ দেশের মানুষের অধিকার আদায়ে ও স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের গান ও কবিতা ছিল আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস।

» এসেছি বাঙালি ক্ষুদিরাম আর সূর্য সেনের থেকে।

ব্যাখ্যাঃ ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনের সশস্ত্র যোদ্ধা মাস্টার দা সূর্য সেন আর ক্ষুদিরামকে কবি বাঙালি ঐতিহ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ক্ষুদিরাম বসু (১৮৮৯-১৯০৮ খ্রি.) মেদিনীপুর জেলার মৌবনি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ফাসিতে ঝুলিয়ে এই মহান বিপ্লবীকে হত্যা করা হয়। মাস্টার দা সূর্য সেন (১৮৯৩-১৯৩৪ খ্রি.) চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার নােয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ইংরেজদের অস্ত্রাগার লুট করে তিনি তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং চট্টগ্রামের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। তাকেও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।

» এসেছি বাঙালি জয়নুল আর অবন ঠাকুর থেকে।

ব্যাখ্যাঃ বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিপুল শিল্পকর্মের পটভূমিতে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে  কবি স্মরণ করেছে। জয়নুল আবেদিন (১৯১৪- ১৯৭৬ খ্রি.) কিশােরগঞ্জের কেন্দুয়া থানায় জন্মগ্রহণ করেন। চিত্রশিল্পী ও শিশুসাহিত্যিক অবনঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১ খ্রি.) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

» এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে।

ব্যাখ্যাঃ ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে কবি বাঙালির ঐতিহ্য হিসেবে স্মরণ করেছেন। কারণ বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী চেতনার পথ ধরেই সূচিত হয় স্বাধীনতা আন্দোলন।

» এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।

আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে।

আমি যে.এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।

ব্যাখ্যাঃ বাংলা ও বাঙালির অবিসংবাদী নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিস্ময়কর প্রতিভাদীপ্ত নেতৃত্বে দীর্ঘ সংগ্রামের পথ অতিক্রম করেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। বাঙালির ঐক্য ও সংহতির প্রতীক ‘জয় বাংলা’ স্লোগান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠের ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের অবিস্মরণীয় ভাষণ বাঙালির প্রেরণার উৎস।  

Leave a Comment